করোনাকালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে উচ্চ শিক্ষা: একটি সময়োপযোগী বাস্তবতা

প্রকাশিত: মে ৯, ২০২০; সময়: ২:১৪ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
করোনাকালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে উচ্চ শিক্ষা: একটি সময়োপযোগী বাস্তবতা

মো. আবদুল কুদ্দুস : মানুষের জীবন এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ভার্চ্যুয়াল জীবন অন্যটি হলো বাস্তব জীবন। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই এখন ভার্চ্যুয়াল জীবনে প্রবেশ করেছে। সারা দুনিয়ার মানুষের বাস্তব জীবন এখন করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাসে নিজ ঘরে আবদ্ধ। তাই জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বাস্তব জীবনকে ছুটি দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সৃষ্ট ভার্চ্যুয়াল জীবনে। মানুষের কর্ম এখন আর জমিনে নেই। উঠে গেছে আকাশের স্যাটেলাইট সেটশনে। ধূঁমায়িত মেঘের ভেতরে। কারণ জমিনে এখন চলছে কোভিড-১৯ এর মহামারী। মানুষ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চ্যুয়ালী কাজ-কর্ম সম্পন্ন করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে ভর্চ্যুয়াল জীবন বাস্তব জীবনের থেকেও বেশী শক্তিশালী। সেই কারণেই হয়তো বিশ্ব অন-ডিমান্ড অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি আমাজন ডট কম ও আলিবাবা ডট কম নিজেদের কোন কন্টেন্ট ধারণ না করেও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থের মালিক হয়েছে। এই আশ্চর্য্য শুধু ডিজিটার প্রযুক্তির। শুধুই ডিজিটাল প্রযুক্তির। অন্য কিছুর নয়।

করোনা ভাইরাসের কারণে অবরুদ্ধ পৃথিবী, রুদ্ধ অর্থনীতি, বিপর্যস্ত মানুষের জীবন। তাই দ্রুত পরিবর্তীত এই পরিস্থিতিকে মেকাবেলা করার জন্য দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম কেমন হবে তা গভীরভাবে ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষকরা অবশ্য বসে নেই। পরিবর্তীত এই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষকে উপযোগী করে তুলতে অনেক গবেষক আজ উচ্চ শিক্ষার জন্য নানামাত্রিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। যেমন লুইস স্টার্কির ‘টিচিং এন্ড লার্নিং ইন ডিজিটাল এজ’, লিন্ডা হারিজমের ‘লার্নিং থিওরি এন্ড অনলাইন টেকনোলজিস’, সুসান কু ও স্টিভ রোজেনের ‘টিচিং অনলাইন: এ প্র্যাকটিক্যাল গাইড’, বইগুলো এ বিষয়ে আমাদের বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠদানের পদ্ধতি কেমন হবে তা সহজ সরল ভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই প্রবন্ধে উপর্যুক্ত উৎস থেকেই গৃহীত আলোচনা থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পঠন-পাঠন বিষয়ক কিছু মৌলিক ধারণা আমরা পেতে পারি।

‘অনলাইন লার্নিং কনসোর্টিয়াম’ ডিজিটাল পদ্ধতিতে পঠন-পাঠনের বিষয়কে তিনভাগে ভাগে ভাগ করেছে। যার প্রথমটি হলো ওয়েব ফ্যাসিলিটেটেড বা ওয়েব এনহান্সড, দ্বিতীয়টি হলো ব্লেন্ডেড/হাইব্রিড এবং তৃতীয়টি হলো ট্রু অনলাইন পদ্ধতি। ওয়েব ফ্যাসিলিটেটেড পদ্ধতিতে ১-২৯ শতাংশ বিষয়বস্তু অনলাইনে দেওয়া থাকে। এই পদ্ধতিতে সহায়ক ব্যবহার্য টুলস হলো ওয়েবসাইটস, মোবাইল অ্যাপস, লানিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস (এলএমএস)। এলএমস-এ সাধারণত কোর্স কারিকুলাম, ওয়েব বেইজব রিসোর্স, কোর্স ক্যালেন্ডার, একটি রিডিং লিস্ট, লেকচার নোটস ও ভিডিও, ডিসকাসান বোর্ড ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে সাধারণত ৩০-৭৯ শতাংশ বিষয়বস্তু অনলাইনে প্রদান করা থাকে কিন্তু এখানে ছাত্র-শিক্ষকের ফেইস টু ফেইস আলোচনার বিষয় প্রধান্য পায়। ট্রু অনলাইনে ৮০ শতাংশের বেশী বিষয়বস্তু অনলাইনে প্রদান করা হয়ে থাকে যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে ফেইস টু ফেইস আলোচনার সুযোগ অনেক কম।

ভর্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের জন্য দরকার ‘ভার্চ্যুয়াল ক্লাশরুম’। দরকার ভার্চ্যুয়াল প্রশাসন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ করে যাচ্ছে যেখানে কিছু শিক্ষক তাদের কোর্সের ভিডিও ভার্সন কন্টেন্ট শেয়ার করে রাখছেন। কিছু শিক্ষক তাঁদের লেকচার নোট পোস্ট করে থাকেন এবং কিছু শিক্ষক এক সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের সাথে অনলাইনে সাক্ষাৎ করেন এবং অন্য সপ্তাহে ক্যাম্পাসে সাক্ষাৎ করে প্রয়োজনীয় পঠন-পাঠন সম্পন্ন করেন। বর্তমান করোনাকালের এই অবরুদ্ধ জীবনে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সময়কে দুইভাগে ভাগ করে নিতে পারেন। একটি হলো ভার্চ্যুায়াল অফিস আওয়ার আর অন্যটি হলো রিয়াল টাইম কমিউনিকেশন্স। ভার্চ্যুয়াল অফিস আওয়ারে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘন্টা সময় শিক্ষক তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে চ্যাট সেশন অথবা ভিডিও কলের মাধ্যমে পাঠদান এবং কনসাল্টেশন করে থাকবেন। অপরদিকে রিয়েল টাইম কমিউনিকেশন্স পদ্ধতি শিক্ষকগণ ঘরে বসে অথবা অফিসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ প্রজেক্ট, অনলাইন প্রেজেন্টেশন এবং ওয়েব বেইজড অনুশীলনীর কাজ দিয়ে কোর্সের পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারেন। অনলাইন কলাবোরেটিভ লানিং এর আওতায় শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনলাইন কেইস স্টাডিজ, স্টুডেন্টস লিড অনলাইন সেমিনারসহ নানাপদ্ধতির মাধ্যমে শ্রেণি কক্ষের বাহিরেও শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা যেতে পারে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাবে নব উদ্ভাবিত এই পঠন-পাঠন পদ্ধতির কার্যকরীতার জন্য দরকার শিক্ষক ও প্রশাসনের উচ্চ পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা। শিক্ষক অবশ্যই বুঝতে সক্ষম হবেন যে তাঁর ছাত্র কী জানে আর কী জানে না। শিক্ষককে অবশ্যই তাঁর শিক্ষার্থীর শিক্ষা মনোবিজ্ঞান বুঝতে হবে। শিক্ষককে বিষয় ভিত্তিক প্রচুর জ্ঞান অর্জন করতে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ভিতরে অথবা এর বাহিরে কি ঘটছে তা শিক্ষার্থীদেরকে বুঝার এবং সমালোচনা করার দক্ষতা অর্জন করাত সক্ষম হতে হবে। শিক্ষকগণ এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখবেন কিছু শিক্ষার্থী সাধারণত শুনে ও নোট গ্রহণের মাধ্যমে বেশী শিখে থাকে। কিছু শিক্ষার্থী লেকচার শোনার থেকে বেশী বেশী পড়ে শিখে থাকে। আবার কিছু শিক্ষার্থী শিখে বেশী বেশী অ্যাসাইনমেন্ট করার মধ্য দিয়ে। সুতরাং সবসময় অনলাইনে নোট ও লেকচার পোস্ট করে যে সকল শিক্ষার্থীকে সমানভাবে শেখানো যাবে তা কিন্তু নয়। সুতরাং পঠন-পাঠনের উত্তম মাধ্যম কী হবে তা একজন শিক্ষক তাঁর পেশাগত দক্ষতা প্রয়োগ করে উদ্ভাবনের জন্য নিরলস কাজ করে যাবেন। ট্রেনিং এর জন্য অপেক্ষা নয়!

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক, মোবাইল: ০১৭১৭৮৫৪১০৪

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে