শতকরা হিসাবে শিক্ষা বাজেট বেড়েছে .০১ শতাংশ

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২০; সময়: ৪:৪১ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
শতকরা হিসাবে শিক্ষা বাজেট বেড়েছে .০১ শতাংশ

মোস্তফা মল্লিক : আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। খুব স্বাভাবিকভাবেই অঙ্কের হিসাবে দেখা যাচ্ছে নতুন অর্থবছরে পাঁচ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা বাড়ছে শিক্ষাখাতে। যদি মোট বাজেটের সঙ্গে মেলানো হয় তাহলে দেখা যাবে শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধি .০১ ভাগ। তথ্য ঘাঁটলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। বর্তমান অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ মোট বাজেটের ১১.৬৮ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ ১১.৬৯ শতাংশ।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে গত মার্চের মাঝামাঝি হতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এতে করে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছুটিকালীন সময়ে টেলিভিশন ও অনলাইনে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হয়। শিক্ষা খাতে আমাদের আগামী অর্থবছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে এ দীর্ঘ ছুটির ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।’ কিন্তু যে বক্তৃতা অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন তার সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটের তো কোনও মিল নেই। পুরো শিক্ষা কার্যক্রম যেখানে চ্যালেঞ্জের মুখে, সেখানে কী করে ইন্টারনেটের দাম বাড়ানো হয়? অর্থমন্ত্রী নিজের মুখেই উল্লেখ করেছেন ৪ কোটি শিক্ষার্থী। মন্ত্রী তার বক্তৃতায় আরও বলেছেন, ‘আমরা গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে আমরা শিক্ষা খাতের বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজিয়েছি এবং সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষাখাতে সম্পাদনের উদ্যোগ নিয়েছি।’ বাস্তবে তো এমন চিত্র দেখা যায় না। এখনও ৯০ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। বেসরকারি শীর্ষ এবং মধ্যম মানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই অনলাইন কার্যক্রম শুরু করেছে শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে। একইভাবে বেসরকারি স্কুল ও একাধিক কলেজ লেখাপড়াকে ধরে রাখতে অনলাইনে শিক্ষা শুরু করেছে। আবার কেউবা করার প্রক্রিয়ায় আছে। বেসরকারি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমন প্রক্রিয়ায় গেছে তাদের নিজস্ব অর্থে। কিন্তু মন্ত্রী যে বললেন, ‘গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলাম যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে আমরা শিক্ষা খাতের বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজিয়েছি…করোনার এমন পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর দেখা গেলো অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন প্রস্তুতি নেই। যে মুহূর্তে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো তখনই এলো মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব। কী করে এটা সম্ভব? ৪ কোটি শিক্ষার্থীর স্বার্থের সঙ্গে কি এটা যায়? মোবাইল, কম্পিউটার আর ল্যাপটপ তো এখন শিক্ষা উপকরণ। যদিও বাংলাদেশে প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ কোটি ৯০ লাখ। এখন কথা বলার ওপর এবং ইন্টারনেটের দাম বাড়ানোর অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীর ওপর বোঝা বাড়ানো। শিক্ষার্থীর ওপর বোঝা মানে হচ্ছে অভিভাবকদের পুরো ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত তৈরি হওয়া। অথচ এমন প্রস্তাব যদি না করা হতো, তাহলে কি দেশ চলতো না? সরকারের উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই না।

ফিরে আসি শিক্ষা বাজেটে-মূল প্রসঙ্গে। এবারের বাজেটে ভৌত অবকাঠামো, বিনিয়োগ, জ্বালানি, সড়ক, পরিবহন খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার ব্যাপারে এসে দেখা গেলো আবারও শুভঙ্করের ফাঁকি। আবারও মানে হচ্ছে এর আগেও এই কাজটি বারবার করা হয়েছে।

প্রতি বছর ১৮ লাখ ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়, পাসও করে ১৪ থেকে ১৫ লাখ। ৩৭টির জায়গায় এখন ৪৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, অসংখ্য ইনস্টিটিউট হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে। জাতীয়করণ করা হয়েছে একাধিকি এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ। সরকারের ঘোষণা আছে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় করবে, প্রতিদিন জনসংখ্যার যে স্রোত, প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি, এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই তো বাজেট হতে হবে। কিন্তু সেটা মনে হয় হয়নি।

এটাও ঠিক সীমাবদ্ধতাও আছে, আমাদের বাজেট সীমিত, তারপরও বলবো: যদি মানসম্মত জাতি গঠন করতে চাই তাহলে তো প্রশিক্ষিত জনশক্তি লাগবে, তাহলে তো জ্ঞানী সমাজ লাগবে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লাগবে। এগুলো কে করবে? এগুলো করবে শিক্ষা। আর এজন্যই শিক্ষায় বিনিয়োগ হতে হবে ভালো। আর সেই বিনিয়োগ করতে হবে যত কষ্টই হোক।

ভারত যদিও বিশাল তারপরও দেশটি কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে খুব একটা শক্ত অবস্থানে নেই। উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবটিতেই আমরা ভারতের সমান। সেখানে জাতীয় আয়ের ৩.৮% শিক্ষায় বরাদ্দ। আমরা ওই পরিমাণে বরাদ্দ দিতে না পারলেও এর চেয়ে এক ভাগ কম দেওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের আছে। মালয়েশিয়ায় শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ৬-৭%। মালদ্বীপে ৮%, আর আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্র নেপালেও শিক্ষায় বরাদ্দ জাতীয় আয়ের ৩%।

আমরা তো ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম লেখাতে চাই। তাহলে এখন থেকেই তো উন্নত বিশ্বের দু’একটা উদাহরণ দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশেও ১.৮৪ শতাংশের বেশি বরাদ্দ শুধু উচ্চ শিক্ষাতেই। আর উন্নত দেশের চিত্র পুরোপুরি আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ ২.৭%। শিক্ষায় বরাদ্দ তো ৮ শতাংশের ওপরে।

তাহলে তাদের সঙ্গে আমরা কী করে প্রতিযোগিতা করবো? আমাদের মেধা দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে। গ্লোবাল মার্কেটে তো আমাদের পক্ষে কিছু নেই। আমাদের প্রতিযোগিতায় তো টিকে থাকতে হবে। প্রতিযোগিতার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান এবং দক্ষতা। এই খাতের বিনিয়োগই হচ্ছে সেরা বিনিয়োগ। এটা দিয়েই সব উত্তরণ সম্ভব। আমাদের গর্ব আর অহংকারের প্রতীক পদ্মা সেতু। সরকার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বলেই এমন অসাধ্য কাজ সম্ভব হচ্ছে বাংলাদেশে। তবে এই সেতুর প্রকৌশলী (বেশিরভাগ) আর প্রযুক্তি তো সব বিদেশ থেকেই আসছে। উন্নত দেশ করতে হলে তো নিজেদেরও প্রকৌশলী বানাতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার দেখাতে হবে। এই বাজেট দিয়ে কি তা সম্ভব?

আমরা যে স্যাটেলাইট উড়িয়েছি তাও তো করে দিয়েছে বিদেশিরা। একমাত্র শিক্ষা খাতে বিনিয়োগই আমাদের স্বপ্ন দেখাতে পারে, এখন বিদেশিরা করলেও নিশ্চিতভাবেই একসময় আমরা স্যাটেলাইট ওড়াবো। ওই স্যাটেলাইটের অর্থ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী—সবই আমাদের লাল-সবুজের বাংলাদেশের।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিতে হবে নতুন নতুন স্ট্রাকচার, ২০১০-এর করা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে লাগবে অর্থ। আমাদের শিক্ষানীতিতে কথা ছিল শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল ঘোষণা করা হবে। বাজেটে তো এ বিষয়ে শুধু এবারই না, কখনও কিছুই বলা হয়নি। ১০ বছর পর চলতি অর্থবছরে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। আবেদন করা দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা এলেও করা হয় দুই হাজার ৬১৫টি। এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় থাকা সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনও নির্দেশনা নেই বাজেটে। অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকরাও এমপিওর দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনে আছেন বহু বছর।

অঙ্ক, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে ভালো করে এজন্য কঠিন পরীক্ষা গ্রহণ করে সারা দেশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল কয়েক হাজার অতিরিক্ত শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দফায় দফায় ঘোষণা দিয়েছিল অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকদের (এসিটি) হয় এমপিও অথবা স্থায়ী করা হবে। একটি বাজেটেও এ বিষয়ে কোনও নির্দেশনা আসেনি, নির্দেশনা আসেনি এবারও। অথচ গেলো বছরের শেষ দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিল এসিটি অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যানারে।

করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওই সময় থেকেই বন্ধ আছে শিক্ষার্থীদের বেতন আদায় কার্যক্রম। এজন্য সরকারের কাছে ননএমপিও শিক্ষক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনসহ শিক্ষকদের ৩০/৪০টি সংগঠন শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিশেষ অনুদানের জন্য দাবি জানিয়েছিল। অথচ বাজেটে এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। সরকার বরাদ্দ যদি দিতে নাও পারে, তারপরেও যদি নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলেও জাতি যারা গঠন করেন তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পান।

একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। ফিলিপাইনের ১৫ লাখ মানুষ প্রবাসী। তবে তারা প্রায় সবাই প্রশিক্ষিত। ৩৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায় ফিলিপাইনের প্রবাসীরা। আর বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ প্রবাসী। রেমিট্যান্স পাঠায় মাত্র ২৫ বিলিয়ন। কারণ শিক্ষিতরা সব সময়ই এগিয়ে থাকে। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। যদিও বর্তমান সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছে তাতে একটা শক্ত অবস্থানে গেছে শিক্ষা খাত।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে সরকার যথাযথ বিনিয়োগ করবে। আর পরিস্থিতি যদি হয় করোনাভাইরাসের মতো এমন জটিল, তাহলে তো বিনিয়োগ হবে উদাহরণ তৈরির মতো। এই বিনিয়োগের ফল মুহূর্তের মধ্যে পাওয়া যাবে না সত্যি, কিন্তু দেশ যে তরতর করে সামনে এগিয়ে যাবে সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই। সভাপতি, বাংলাদেশ এডুকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম-বিইআরএফ

সূত্র : বাংলাট্রিবিউন

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে