প্রতিবাদ হোক সব অন্যায়ের
প্রভাষ আমিন : ছেলেবেলায় ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লেখেননি, এমন কেউ নেই। জরিপ করলে এসব রচনায় সবচেয়ে বেশি ছেলেমেয়ের জীবনের লক্ষ্য হবে ডাক্তার হওয়া এবং মানুষের সেবা করা। সব ডাক্তারই যে মানুষের সেবা করেন এমন নয়, আবার মানুষের সেবা করতে হলে ডাক্তারই হতে হবে এমনও কথা নেই। তার চেয়ে বড় কথা হলো, ইচ্ছা যতই থাকুক চাইলেই যে কেউ ডাক্তার হতে পারে না। ডাক্তার হতে হলে সর্বোচ্চ মেধা, কঠোর পরিশ্রম আর কখনো কখনো বাবার যথেষ্ট টাকাও থাকতে হয়। সরকার স্বীকৃত কোনো মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন, ইন্টার্নি শেষ করার পরও তিনি পুরোপুরি ডাক্তার নন। কারও চিকিৎসা দিতে হলে তাকে অবশ্যই বিএমডিসির তালিকাভুক্ত হতে হবে। আর এমবিবিএস পাস করার পর সমপর্যায়ের অনেকের পড়াশোনা যখন প্রায় শেষ, ডাক্তারদের আসল পড়াশোনা যেন তখন শুরু হয়। এত শ্রম, মেধা আর সম্পদ বিনিয়োগে যে ডাক্তার গড়ে তোলা, সেই ডাক্তারের বিরুদ্ধে আমরা কথায় কথায় ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনি, মারধর করি, এমনকি মেরেও ফেলি। সম্প্রতি রোগীর স্বজনদের হামলায় আহত হওয়ার ১৮ ঘণ্টা পর মারা গেছেন খুলনার এক ক্লিনিক মালিক ডা. আবদুর রকিব খান।
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ভুল চিকিৎসার। ভুল চিকিৎসা যে হয় না, তা বলব না। ভুল চিকিৎসায় যেমন মানুষ মারা যায়, সঠিক চিকিৎসা হলেও তো মানুষ মারা যেতে পারে। কেউ মারা গেলে তার স্বজনদের কাছে সব চিকিৎসাই ভুল মনে হতে পারে, তিনি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়ে চিকিৎসককে পিটিয়ে মেরে ফেলা তো কোনো সভ্যসমাজের সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। একটা আইন-কানুন আছে, সংক্ষুব্ধ মানুষের বিচার চাওয়ার সুযোগ আছে। সবাই যদি নিজ নিজ ক্ষোভ মেটানোর দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন, তাহলে তো দেশটা শ্মশান হয়ে যাবে। হতে পারে সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও রোগী মারা গেছেন। হতে পারে সত্যি চিকিৎসাটা ভুল হয়েছে। হতে পারে ভুলটা অনিচ্ছাকৃত, আবার হতে পারে অদক্ষতা বা খামখেয়ালিপনা। যা হোক তা নির্ধারণ করে, ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে, তাকে মৃত্যুদ- দিয়ে দেওয়ার মতো যোগ্যতা ও অধিকার নিশ্চয়ই আমার-আপনার নেই।
নিশ্চয়ই আপনারা বলবেন, তাহলে কি ডাক্তাররা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবেন? তারা কি সব আইনের ঊর্ধ্বে? না, আমি তেমন দাবি করছি না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। ডাক্তারদের যেমন ভুল চিকিৎসা, অদক্ষতা বা খামখেয়ালি করে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার নেই; মানুষেরও তেমন আইন হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই। ডাক্তারদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিএমডিসিকে সচল ও সক্রিয় করতে হবে। কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তিনি বিএমডিসিতে অভিযোগ করবেন। বিএমডিসি দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। সে ব্যবস্থা সতর্কীকরণ, সার্টিফিকেট বাতিল থেকে শুরু করে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত হতে পারে। প্রয়োজনে বিএমডিসির সুপারিশে ডাক্তারদের গ্রেফতারও করা যেতে পারে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভুল চিকিৎসার দায় চাপিয়ে মারধর করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। নইলে ভুল চিকিৎসায় না হলেও বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে। ঘাড়ের ওপর মারের ভয় নিয়ে কোনো ডাক্তারের পক্ষেই সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
সব আইনের ঊর্ধ্বে না হলেও ডাক্তারদের জন্য অবশ্যই আলাদা আইন দরকার। ডাক্তারদের পেশাটা বিশেষ, তাদের জন্য আইনও হতে হবে বিশেষ। কথায় কথায় ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলা, ভুল চিকিৎসার অভিযোগে হামলা করা, ভাঙচুর চালানো যেন ডালভাত। সবার আগে ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বাঁচাতে হবে। ডাক্তাররা না বাঁচলে, তারা আপনাকে বাঁচাবে কীভাবে! ডাক্তাররা যাতে নির্ভয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে পারেন, সেজন্য তাদের সুরক্ষায় বিশেষ আইন করতে হবে। পুলিশের গায়ে হাত তোলা যেমন অপরাধ, ডাক্তারের গায়ে হাত তোলাটাও ততটাই অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। রোগী মারা গেলেই ডাক্তারের দোষ, ভুল চিকিৎসা; এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশেষ সুরক্ষা আইন করার কথা বলায় ফেসবুকে একজন বলেছিলেন, আইন সবার জন্য সমান। সবার সমান অধিকার। কিন্তু আমি কখনোই সমান অধিকারে বিশ্বাসী নই। আমি বিশ্বাস করি ন্যায্য অধিকারে। যার যতটুকু দরকার, রাষ্ট্র তাকে ততটুকুই দেবে।
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার আগে বা তাদের গায়ে হাত তোলার আগে একবার ভাবুন, করোনার এই দুঃসময়- যখন বোন ফেলে যাচ্ছে ভাইকে, সন্তান ফেলে দিচ্ছে মাকে, এমনকি বাবা ফেলে দিচ্ছে সন্তানকে; তখনো কিন্তু ডাক্তাররা প্রাণের মায়া না করে সীমিত সামর্থ্যে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তাররা ফেরেশতা নন। তাদেরও ভুল হয়, তাদের চেষ্টার পরও মানুষ মারা যাচ্ছে। ভাবুন একবার, সবকিছুর পরও পৃথিবী ছাড়ার আগে আপনার স্বজনের কপালে মমতার শেষ ছোঁয়াটুকু কিন্তু একজন ডাক্তারেরই। করোনাযুদ্ধে ফ্রন্টলাইন ফাইটার ডাক্তাররা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন; তবু তারা কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছাড়েননি।
এ করোনাকালে একজন ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা অবিশ্বাস্য। তার চেয়েও অবিশ্বাস্য একজন সিনিয়র ডাক্তারকে মেরে ফেলার ঘটনায় তেমন প্রতিবাদ না হওয়া। ডাক্তাররা টুকটাক প্রতিবাদ করলেও সর্বজনীন প্রতিবাদ হয়নি। নীরব থেকে কি আমরা এ আইন হাতে তুলে নেওয়াকে সমর্থন করছি? ডাক্তার বা কোনো নির্দিষ্ট পেশা বা গোষ্ঠী বা ধর্মের মানুষের প্রতি কোনো অন্যায় হলে যখন শুধু সেই পেশা বা গোষ্ঠী বা ধর্মের মানুষই শুধু প্রতিবাদ করে; তখন আমি হতাশ হই, মানুষ হিসেবে ছোট হয়ে যাই। যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে সবাইকে, সবাই মিলে। ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেললে যেমন সবাইকে প্রতিবাদ করতে হবে; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ব্যাংক হিসাব তলব করে সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধের চেষ্টা হলে তার প্রতিবাদও সবাইকে করতে হবে। একদিন যখন আপনার ওপর অন্যায় হবে, তখন দেখবেন প্রতিবাদ করার কেউ নেই। কোনো ঘটনা ঘটলে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, যদি আপনার মনে হয় অন্যায়; প্রতিবাদ করুন। পেশা, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত দিয়ে যাচাই করবেন না। অন্যায় সবসময়ই অন্যায়। তার প্রতিবাদ করতে হবে সবাইকে।
লেখক : সাংবাদিক।
সূত্র : বাংলােদশ প্রতিদিন