শতবর্ষে তুরস্কের খেলাফত পুনর্দশন

প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২০; সময়: ৩:৫৬ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
শতবর্ষে তুরস্কের খেলাফত পুনর্দশন

ফজলে রাব্বী : আধুনিক তুরস্কের উত্থানের ইতিহাস বাংলাদেশের বিদ্যায়তানিক ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, শুরু হয়েছে মুস্তফা কামালের ক্ষমতারোহনের পর থেকে। তিনিই খিলাফতের অবসান ঘটিয়ে তুরস্ককে পাশ্চাত্য ভাবধারার দিকে ধাবিত করেন। এবং এই মত এখনো বাংলাদেশে প্রবলভাবে বিরাজমান। দুই মতধারার পন্ডিতদের মধ্যে ইসলামী ভাবধারার চিন্তাধারা তো সেই ১৯১৯ সাল থেকেই এই মত পোষণ করে আসছেন, আর সেক্যুলার ভাবধারার চিন্তাবিদরা মনে করেন মুস্তফা কামালই যুগন্ধর পথপ্রদর্শক। কাজী নজরুল ইসলাম তো কবিতাই লিখে ফেললেন কামাল পাশা। ‘ঐ চলেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই…’

কিন্তু আমাদের প্রস্তাব তুরস্কে আধুনিকায়নের সূচনা হয়েছিল আরো আগে, তুরস্কে কামাল পাশা আসার পূর্বে সেখানে খেলাফত শাসন ছিল শুধু এই যুক্তিতে যদি কামালপূর্ব তুরস্ককে আধুনিক বলা না হয়। যায়, তাহলে ওই একই যুক্তিতে বর্তমানের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পন্ন ইংল্যান্ডেকে আধুনিক বলাটা যুক্তিসম্মত হবেনা। কেননা ইংল্যান্ডে অদ্যাবধি ইংল্যান্ডে রাজা-রাণীর খেলাফত আমল বিদ্যামান। তুরস্কের সাথে বাংলার ইতিহাস বহু পুরনো। কম সে কম ৮০০ বছরের পুরোনো সম্পর্কের খাতিরে আমরা তুরস্কের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতেই পারি। উপরন্তু তুরস্কের রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে এই বাংলায়ও আন্দোলন হয়েছিল। প্রায় ১০০ বছর হতে চলল। কোন ঘটনা ইতিহাস হওয়ার জন্য ১০০ বছর যথেষ্ট সময় কিনা সে তর্ক বাইরে রেখেও আমরা কিছু কথা বলতে পারি।

ইউরোপের সাথে তুরস্কের আত্মীয়তা বহু পুরাতন হলেও ইউরোপীর ঘরানার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সেনাবাহিনীর গড়ার কাজ তুরস্কে শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীল গোড়ায় দিকে। তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের (১৮০৮-৩৯) সময় কালকেই ঐতিহাসিকের তুসস্কের আধুনিকায়নের সূচনাকাল রূপে চিহ্নিত করেছেন।

১৮২৬ সালের শীতকালের শুরুতে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন শুরু হয়। এরই মধ্যে ইস্তাম্বুলে প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। এবং তা মনসুর ব্যারাক পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনাসদস্যের প্রাণহানি হয়। তাছাড়া আগুন লেগে ইস্তাম্বুলের পুরনো অংশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। ফলে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের জন্য ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়, যা মেটাতে সরকার তার সাম্রাজ্যের কোষাগার নিজ হাতে তুলে নেয়। উল্লেখ্য এই কোষাগার পূর্বে উচ্চ পদস্থ কর্মকতা দ্বারা পরিচালিত হত এবং ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যয় হত (Nezarat-i-Evlcaf ) । এই ঘটনা শত শত আলেমের মনে আশংকার জন্ম দেয়। কেননা এই কোষাগার থেকেই তাদের পেনশনাদি দেওয়া হত। তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু তারপরও সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুন্ধে তাদের ক্ষোভ বিদ্রোহে রূপান্তরিত হতে পারে নি। কেননা সুলতান মহামুদ শুধু উলেমাদের নেতাদেরই বশ করেন নি, তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে অটোমান ইতিহাসের প্রচারনা চালান যা জনমতকে তার বিরুদ্ধে যেতে দেয় নি। মাহমুদ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চেয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ ইস্তাম্বুলের কেন্দ্রীয় সরকার কাঠামোর পরিবর্তন আনা হয়। এর ফলে প্রাসাদে এবং তথাকথিত মহান তুরস্ক সরকারের (Subline Porte) সেনা শক্তি ও ধর্মভিত্তিক শ্রেণীগুলোর দীর্ঘদিন ব্যাপী চলে আসা ক্ষমতাজোটকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।

ফলত: তুরস্কের কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত ইউরোপীয় ঘরানার সরকার কাঠামোর রূপ পরিগ্রহ করল, এমনকি সরকারে শাসনবিভাগ ও আইনবিভাগ পর্যন্ত পৃথকীকৃত হল। আমরা জানি সরকারের তিনটি বিভাগ-পৃথকীকরণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যাকরণের প্রধানতম খুঁটি। যদি এর ফলে প্রাসাদকেন্দ্রিক ক্ষমতা ও সরকার কেন্দ্রীক ক্ষমতার টানাপোড়েন অল্প পরিমানে হলেও বজায় থাকল। যা আমরা দেখি বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নেও বজায় ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কারের পর দ্বিতীয় মাহমুদ নগর সরকারের দিয়ে মনোযোগ দেন। প্রথাগত অটোম্যান শাসন কাঠামোতে নগরগুলোতে সরকারী কার্যক্রম পরিচালনার করার পরিসর ছিল খুবই সীমিত। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে অংশ হিসেবে যতটুকু এখতিয়ার ততটুকুই সরকারী কর্মকর্তারা ইস্তাম্বুল সহ অন্যান্য শহরের প্রয়োগ করাতে পারতেন। ইস্তাম্বুলসহ অন্যান্য প্রধান প্রধান নগরীগুলোতে বেসরকারী সংস্থাগুলোর সাথে ধর্মীয় মুহতাসির (Muhtesip) অর্থনৈতিক বিষয় গুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। ইস্তাম্বুলে পুলিশী ও অগ্নিনির্বাপন কার্যক্রম সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত।

এছাড়া অন্যান্য নগর ও গ্রামে মুসলিম আদালত আইন ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ইস্তাম্বুলের সেনা ইউনিট ভেঙ্গে দেন এবং নগরীতে বিশেষ ধরনের পুলিশী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সরকারী কর্মকর্মতাদের নগরীর প্রশাসনিক দায়িত্ব নির্বাহের পরিসর বৃদ্ধি করা হয়। পূর্বোক্ত মুসলিম শাসন কাঠামো ধীরে ধীরে তুলে দিয়ে ইউরোপীর প্রশাসন কাঠামো অনুসরণ করা হয়। তুর্কী সাম্রাজ্যে প্রত্যেকটি শহরে মুসলিম, অ-মুসলিম এলাকা নির্বিশেষে মেয়র (Muhtar), লেফটেন্যান্ট (Kahya) পদে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। তুরস্কের শাসনতার্ন্ত্রিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে ১৮৩৯ সাল নাগাদ। শুরু হয় নতুন কাল যা তানজিমাতই হেইরিয়ে বা আশাব্যঞ্জক পুনর্গঠন নামে পরিচিত। নব সংস্করণের কৃতিত্বের দাবীদার দ্বিতীয় মাহমুদের দুই পুত্র প্রথম আবদুল মেসিত (১৮৩৯-৬১) এবং আবদুল আজিজ (১৮৬১-১৮৭৬)। এই সময়কালে সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতা আরো বেশি কেন্দ্রীভূত ও দূরীকরণ করা হয়। অটোম্যান সমাজকাঠামোতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশ গ্রহন আরো বেশি বৃদ্ধি করা হয়। ১৭৬৮ সালে আইন ও বিচার কাঠামোর আরো বেশি পরিবর্তন সাধন করা হয়। সুপ্রীম কাউন্সিল আইনবিভাগ ও বিচার বিভাগ দুইটি পৃথক সংস্থায় পরিণত হয়। ফলে তুর্কী সাম্রাজ্যের ইতিহাসের প্রথমবারের মত, ধর্ম নিরপেক্ষ আদালত ব্যবস্থার সূচনা হয়। এই গেল তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস। এই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তুরস্কে অটোম্যান সমাজ কাঠামো, শাসন কাঠামো সমান্তরালে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো একসময় ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে পৃথকীকরণ শুরু করে এবং দেখা যায় আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর যে গঠন আমরা দেখি তা ১৯১৯ সালের পূর্বেই তুরস্কে কায়েম হয়।

প্রশ্ন আসে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সংস্কার সাধনের প্রতিক্রিয়া কী রূপ ছিল এবং সংস্কারকৃত কাঠামোর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কী রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় মাহমুদ যখন সেনাবাহিনীতে এবং শাসন কাঠামোতে পরিবর্তন আনেন তখন খুব বেশি বিরোধীতার সম্মুখীন হননি। তিনি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন পুরোনো ধারার অটোম্যান রাষ্ট্রকাঠামোতে তুরস্ককে খুব বেশি এগিয়ে নেওয়া যাবে না। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার টিকিয়ে রাখার কথাও একজন শাসককে মাথায় রাখতে হয়। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ বিচক্ষণ ছিলেন বলে সরাসরি উলেমা গোষ্ঠী পরিচালিত মক্তব ভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বাতিল করতে যান নি। ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার অধীন শিক্ষিত সকল শিক্ষার্থীই উপমা হিসেবে কর্মজীবন বেছে নিতে চাইত না। তাই সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ওই সমস্ত যুবকদের জন্য বিশেষ ধরনের স্কুল চালু করলেন। সেই স্কুলগুলোতে ব্যাকরণ, ইতিহাস, গণিত পড়ানো হত তাদের, যারা সামরিক স্কুলে ভর্তি হতে চাইত, অন্যান্য দুনিয়াবী পেশায় যেতে চাইত প্রত্যেকের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। সেই স্কুলগুলোতে আরবী, ফরাসী, ভূগোল, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণিত সবই পড়ানো হত। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্র ১৮৩৯ সালের পর মোটামুটি ধর্মনিরপেক্ষ, শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। এভাবে উনিশ শতকের শেষ নাগাদ সমাজবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যাসহ সব রকমের ব্যবহারিক ইহলৌকিক শিক্ষা কার্যক্রম বিকশিত হয়। এবং এই শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশের সাথে সাথে সমাজ নতুন শ্রেণীর মানুষ তৈরী হল।

পোশাক আশাক কিংবা চালচলনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছিলেন মাহমুদ নিজে। তিনি ইউরোপীয় শাসকদের মত পোষাক পড়তেন, চলাফেরা করতেন। এমনকি দাড়ি ছোটকরে ছাঁটতেন: কোট ট্রাউজার পরিধান করতেন। তাছাড়া ইউরোপীয় সংস্কৃতির সাথে তুর্কি সংস্কৃতির ব্যপক সম্মিলন ঘটেছিল ইউরোপ হতে তুরস্কে আগত অভিবাসী গণের সংস্পর্শে। এই সমস্ত ঘটনাবলী তুরস্কের আধুনিকায়নে সক্রিয় অনুঘটকের কাজ করেছে। যদিও অনেক অটোম্যান এই পরিবর্তনের বিরোধীতা করেছিল কিন্তু নতুন সমাজ কাঠামোয়, তারা অযোগ্য হবার আশংকায় সে বিরোধীতা বেশি দিন টেকে নি, উঠতি নতুন শাসক শ্রেণী পুরাতন মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে নতুন সমাজ কাঠামো গড়ে তুলেছিল। সমাজ পবির্তনের সূর্যের নবোদয় ঘটেছিল। তুরস্কের এই পরিবতর্ণ শুধু উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ভাবলে ভুল হবে। মনে রাখতে হবে, তুরস্ক তার অতীত ঐতিহ্যকে একেবারে ভুলে যায নি, শাসন কাঠামো ও শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নতির মাধ্যমে তারা এমন একটা অবস্থা তৈরী করেছিল যা ছিল আসলে সে যুগের দাবী। আর পূর্ববর্তী সমস্ত পরিবর্তণ, সংস্কার সবকিছু পূর্ণরূপ পরিগ্রহন করা ১৯১৯-১৯২২ এই সময়কালে যা তুরস্ক ও পাশ্চাত্রের বিদ্যায়তনিক প্রাক্তরা। তুরস্ক বিপ্লব বলে বিবেচনা করেন। এবং কামাল পাশাকেই সেই বিপ্লবের ফসল বললে কম ও বলা হয় না বেশিও বলা হয় না। তুরস্কের আধুনিকায়নের এই দিকটি ধরা যায় নি বলে বাংলায় দুই ধরনের গোঁড়া ‘ডিসকোর্স’ জন্ম নিয়েছে।

* লেখক ও গবেষক

[email protected]

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে