ছেলে আমার বড় হবে
রাশিদুল হক রুশো : দিনটির কথা এখনও স্পষ্ট মনে। ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অস্থির মনে পাইচারী করে চলেছি। কারণ ভেতরে আমার স্ত্রী ঝুমুরের সিজারিয়ান অপারেশন চলছে। কনসিভ করার পর থেকে সে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাজশাহীতে না পেরে অবশেষে ঢাকায় নেয়া হয়। অপারেশনের আগে ডাক্তারের কথাগুলো কেমন যেন কানে ভাসছিলো, `যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরী থাকবেন। অপারেশন চলাকালীন খিচুনি কন্টোল না করা গেলে যে কোন কিছুই ঘটে যেতে পারে’। আমার চোখ শুধু ঘড়ির কাঁটার দিকে। আর কতক্ষন, সময় কেন যায় না। ঘড়ির কাঁটাগুলো কি সব থমকে গেছে? এমনই অবস্থায় হঠাৎ করেই অনেকটা থমকে দাঁড়ালাম। দেখি আমার সামনে হুমায়ূন আহমেদ স্যার!
এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো আমি যেন শূন্যে দাঁড়িয়ে আছি। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সালাম দেবো, তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো, তিনি যদি কথা বলতে আগ্রহ না দেখান, নাহ তার চেয়ে বড়ং চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সরে যাওয়াই ভাল। আবার ভাবছি এত কাছে পেয়েও স্যারের সাথে একবার কথা বলবো না তা কি হয়। কোন কিছুই আর ভাবতে পারছি না। এক বুক সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলাম স্যারের দিকে। কাছে গিয়ে দেখি ওমা ! এতো হুমায়ূন স্যার নয়, তাঁর ছোট ভাই দেশের অন্যতম কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব।
দূর থেকে একবারে হুমায়ূন স্যারের মত দেখতে তিনি। যাই হোক, আহসান হাবীবের সাথে হাত মেলানোর লোভটাও তো আর সামলানো যায় না। তাই একটু সাহস নিয়েই এগুতে লাগলাম তার দিকে। ঠিক তখনই দু’জন নার্স দু’টি ফুটফুটে সদ্য জন্ম নেওয়া বেবী নিয়ে বের হলেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। আমার এবং আহসান হাবীবের পরিবারের লোকজন (হুমায়ূন স্যারের মা আয়েশা ফয়েজ, প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন, ছেলে নুহাশসহ আরও অনেকে) ছুটে গেলেন বেবী দুটির কাছে। নার্স দেখিয়ে দিলেন কোনটা কার বেবী। দূর থেকে আমি আমার পুত্র সন্তানের মুখ দেখলাম। সে কি যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, বাবা হবার আনন্দে একদিকে যেমন বুক ফেটে কান্না আসছে, অন্যদিকে কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে যদি কাঁদতে পারতাম তবে আনন্দটা প্রকাশ করতে পারতাম।
ঠিক এমন সময় একটি ভারি কন্ঠ পেছন থেকে আমাকে প্রশ্ন করলো- বাচ্চার কে হন আপনি? পেছন ফিরে তাকিয়েতো আমি হতবাক, দেখছি আহসান হাবীব আমাকে প্রশ্নটা করেছেন। আমি কিছু না ভেবে আমার ফুলহাতা শার্টের গোটানো হাতাটা দিয়ে আমার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া মুছে নির্বিকারের মত উত্তর দিলাম–বাবা।
এটাই প্রথম কারো সাথে আমার নতুন পরিচয়ে পরিচিত হওয়া। আমার উত্তরটি শুনে আহসার হাবীব একটি মুচকি হাসি দিয়ে তার বাম হাতখানা আমার কাঁধে রেখে তার ডান হাত এগিয়ে দিলেন আমার দিকে হাত মেলানোর জন্য এবং বললেন, ওহহ–কংগ্রাচুলেশন। তার মুখের এই কথা শুনে ম্যাজিকের মত আমার বুকের মাঝের চাপা কান্না, লজ্জা চলে গেলো এক নিমিষেই। আমি আমার হাতটা এগিয়ে দিলাম তার হাতের দিকে, হাত মেলাতে মেলাতে তিনি বললেন, আমার বড় ভাইয়ের (হুমায়ূন আহমেদ) মেয়ের (শীলা) বাচ্চা হলো এখনই। আমি বললাম আপনি তাহলে নানা হয়ে গেলেন। তিনি আবারো মুচকি হেসে বিদায় নিলেন।
বিষয়টি ভাবতে আমার এবং ঝুমুরের ভালই লাগে পাশাপাশি দু’টি অপারেশন টেবিলে আমার স্ত্রীর এবং হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে শীলা আহমেদের সিজার করা হয়েছে এবং আমাদের সন্তান ও হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে প্রিয় কন্যার সন্তানের একইদিনে একই সময়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে। আমাদের ছেলের জন্মর পরপরই এমন এক পরিবারের সংস্পর্শে পেয়েছে যা আমাদের কাছে অনেক বড় পাওয়া বলে আমরা মনে করি।
জানিনা বড় হয়ে আমার ছেলে কি হবে বা কেমন হবে, তবে যদি হুমায়ূন স্যারের পরিবারের সদস্যদের মেধার ধারেকাছেও তার স্থান করে নিতে পারে তাহলেই আমরা নিজেদের সার্থক বাবা-মা বলে মনে করবো। শীলা ও তার মেয়ের জন্যও আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা।
(বি.দ্র. ২০০৯ সালে লিখিত। রাশিদুল হক রুশোর ফেসবুক থেকে নেওয়া)