দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে কি সরকারবিরোধী আন্দোলন সম্ভব?
ড. প্রণব কুমার পান্ডে
দায়িত্বশীল বিরোধী দল একটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের প্রাণ। কারণ, ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য নিশ্চিত করতে বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি নীতি যাচাই করার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত এবং বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করার মাধ্যমে বিরোধী দলগুলো যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে তা হলো সরকার নাগরিকদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে গঠনমূলক বিতর্ক এবং আলোচনাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে সহায়তা করতে পারে বিরোধী দল। দায়িত্বশীল বিরোধী দলগুলো প্রান্তিক গোষ্ঠী বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতামত প্রদানের জন্য কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে, একক দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য রোধ করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার জনগণের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে কথা বলে। সংক্ষেপে, তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণবন্ততা এবং সহনশীলতা নিশ্চিতে অবদান রাখার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে জাতির উন্নতির জন্য কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বাংলাদেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব স্তরের সংগঠনগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে অনেক দিন থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলেও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সময়ে দলটি অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যাহোক, লম্বা সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হলো দলের তৃণমূল সমর্থন এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার দুর্বল হয়ে যাওয়া।
যেকোনও রাজনৈতিক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তৃণমূলে শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখা। এরমধ্যে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে দলের অফিস স্থাপন, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং দলের সমর্থক ও স্বেচ্ছাসেবকদের একটি নিবেদিত নেটওয়ার্ক তৈরি করা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে এই তৃণমূল কাঠামো বজায় রাখা ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে দলটির পক্ষে। বছরের পর বছর ধরে বিএনপি স্থানীয় পর্যায়ে তাদের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করেছে। যার ফলে জনগণের সঙ্গে তার সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত দলের সমর্থকদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।
ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী অনুপস্থিতি দলটির নতুন প্রতিভা আকর্ষণ ও ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তরুণ প্রজন্ম প্রায়ই এমন দলের প্রতি আকৃষ্ট হয় যা তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ দিতে পারে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি সরকারের বাইরে থাকায় তরুণ প্রজন্মের কাছে এর আবেদন কমে গেছে।
অন্যদিকে, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর ধরে তাদের কর্তৃত্ব মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সরকারের অধীনে দেশ অসাধারণ উন্নয়ন অর্জন করেছে যার ফলশ্রুতিতে দলের একটি সু-প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক আধিপত্য বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অসুবিধা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কারণ, তৃণমূলে তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিএনপির তৃণমূল সংগঠনের দুর্বলতা সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কার্যকরভাবে সংগঠিত ও সমন্বয় করার ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করেছে। প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের জন্য সমর্থন সংগ্রহ এবং আন্দোলনের গতি বজায় রাখার জন্য একটি সুসংগঠিত দলীয় কাঠামো প্রয়োজন। যেহেতু তৃণমূলে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে সেহেতু শক্তিশালী সরকারবিরোধী বিক্ষোভের জন্য বিএনপি তাদের সমর্থকদের একত্রিত করতে সংগ্রাম করছে।
ফলে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির দাবি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যা আদায় করা তাদের জন্য কঠিন। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। ফলে, বর্তমান সরকারের পদত্যাগের তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত বিষয় এবং এটির পুনঃস্থাপনের জন্য যে ধরনের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন তা বর্তমানে অনুপস্থিত। তাছাড়া, বিএনপি নিজেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার সম্মুখীন। ফলে তাদের পক্ষে এই দাবি আদায়ের জন্য ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে তোলা কঠিন।
অন্যদিকে, এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেসব রাষ্ট্রকে বিএনপি নিজেদের বন্ধু মনে করছে, তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে কোনও মন্তব্য করেনি। তাছাড়া, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশে এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান সম্ভবপর নয় বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। ফলে, এসব ভয়ংকর বাধার পরিপ্রেক্ষিতে, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি চ্যালেঞ্জিং প্রস্তাব বলে মনে হচ্ছে।
বিএনপির দুর্বলতা নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় সুবিধার মধ্যে একটি হলো ক্ষমতা একত্রীকরণ এবং রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ। বিএনপি তার তৃণমূল সংগঠন টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করার এবং শক্তিশালী সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগ কোনও শক্তিশালী প্রতিরোধ ছাড়াই নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এটি ক্ষমতাসীন দলকে নিজেদের নীতি ও এজেন্ডাগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে, যা আরও স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারকে সহায়তা করেছে।
তাছাড়া, তরুণ প্রজন্মের কাছে বিএনপির ক্ষয়িষ্ণু আবেদন আওয়ামী লীগকে নতুন প্রতিভাকে আকৃষ্ট করতে, তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে এবং নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে সক্ষম করেছে। যেহেতু বিএনপি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার সম্মুখীন হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তাদের অবস্থান আরও সুসংহত করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী অনুপস্থিতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং তাদের তৃণমূল সংগঠনকে দুর্বল করেছে। যদিও বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে স্বীকৃত, তবে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে সরকার বিরোধী কার্যকরী আন্দোলন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি তার তৃণমূল পুনর্গঠন এবং দেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে কাজ করছে। ফলে, তাদের পক্ষে সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের বিষয়টি বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবসম্মত নয় বলেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে।
লেখক- অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।