ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত করবে তরুণেরা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৩; সময়: ২:২০ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত করবে তরুণেরা

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন : ‘নূরলদীন’ নামের এক তরুণ ‘১৭৮২’ (১১৮৯ বঙ্গাব্দ) খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মানুষকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং রংপুরের মানুষ স্থানীয় শাসক ও বৃহত্তর শক্তির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন। নূরলদীনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-বিদ্রোহের আগে ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলায় হয়ে গিয়েছিল ছিয়াত্তরের মনন্তর (১১৭৬ বঙ্গাব্দ)। কোম্পানি বিভিন্নভাবে কৃষকদের ওপর নগ্ন অত্যাচারের স্ট্রিমরোলার চালাতে থাকে। তখন নূরলদীনের মতো তরুণরাই এগিয়ে এসেছেন এদেশের মানুষকে মুক্ত করতে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে ৫২ এবং তার পূর্বাপরের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দেখলেও আমরা দেখতে পাই তরুণরাই এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, মুক্তির জন্য জীবনবাজি রেখেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ৭১ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন খুবই তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। যুগে-যুগে, কালে-কালে এদেশের সাধারণ মানুষ যখনই শোষিত-নির্যাতিত হয়েছে তখনই তরুণ প্রজন্ম তাদের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কখনও একা কখনও বা দলবদ্ধভাবে।

স্বাধীন বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম দেখেনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তরুণরাই মূলত আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে আমাদের যে সংগ্রাম তা মূলত গণতন্ত্রের সংগ্রাম। গণতন্ত্র যতবার এদেশে হোঁচট খেয়েছে ততবারই এদেশ পিছিয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধের পরে গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছেন এদেশের তরুণ সমাজ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। তফসিল হয়ে গেছে। জানুয়ারির ৭ তারিখ নির্বাচন। ২০২৪ সালে এদেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচন করবেন। যারা পরবর্তী ৫ বছর এদেশের মানুষের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল হবেন। এদেশের মানুষ যদি সত্যিই তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে চান তবে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে হবে। ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে। ভোট দিতে হবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই তার ইচ্ছা-আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।

তাছাড়া ভোট দেওয়া নাগরিক অধিকার। ভোট দেওয়া নাগরিক কর্তব্য। ভোট দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভোট মহামূল্যবান। শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, বয়স্ক হোক, যুবক হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, স্বাভাবিক হোক বা সীমাবদ্ধ মানুষ হোক এক ব্যবস্থায় সবার একই অধিকার। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ভোটের সমান মূল্য। এখানে কারও ভোট কম বা কারও ভোট বেশি মূল্যবান নয়। এটাই গণতন্ত্র।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের কোনও বিকল্প নেই। এই ব্যবস্থায় যেমন ৫ শতাংশ ভোট পড়লেও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় তেমনি ১০০ শতাংশ ভোটের মাধ্যমেও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ মানুষের উপস্থিতি উৎসবমুখর পরিবেশ সুষ্ঠু ভোটেরও নিয়ামক। ভোটার কেন্দ্রে যত কম উপস্থিত হন তত অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। অনিয়মকে রুখে দিতে হলেও ভোট কেন্দ্রে যাওয়া প্রয়োজন।

বিশেষ করে তরুণ সমাজকে প্রয়োজন ভোটের ময়দানে। প্রার্থী হিসেবে। কর্মী হিসেবে। ভোটার হিসেবে। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু শিশুকেও আমরা বিভিন্নরকম মিছিলে অংশ নিতে দেখেছি। কারণ ভোট মানে এদেশে ‘ঈদ’। ঈদতো একদিন থাকে। বাংলাদেশে ভোটের বছরে ‘ঈদ’ অন্তত ১ মাস থাকে। যেমন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তেমনি জাতীয় নির্বাচনে।

আমরা সামনে সেই উৎসবমুখর পরিবেশের প্রত্যাশা করছি বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছ থেকে। তরুণ সমাজ যদি গণতন্ত্রের চর্চ্চা না করে তবে কখনোই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি সম্ভব নয়।

২০০৭ সালের আগস্টের ২০-২২ তারিখ যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল তা মূলত ওয়ান ইলেভেনের বিপক্ষে তরুণ সমাজের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-বিদ্রোহ। সেটির কারণও গণতন্ত্র। সেটির কারণ ছিল শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার। সেই আন্দোলনে অনেক ছাত্র-শিক্ষককে বন্দী করেছিলেন ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার। বাংলাদেশ কখনও সেনা শাসন চায় না।

বাংলাদেশ কখনও সেনা সমর্থিত সরকারকে এদেশের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলো আমাদের অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ অনেক বদলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক বদলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক সাহসী। অতীতের থেকেও অনেক বেশি সাহসী। বাংলাদেশের মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। তারা ভুল করবে না। কারণ তারা জানে তারা ভুল করলে হেরে যাবে তারা নিজেরাই। আর বাংলাদেশের জনগণের হেরে যাওয়া প্রকারন্তরে গণতন্ত্রের হেরে যাওয়া।

মুক্তিযোদ্ধার হেরে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের হেরে যাওয়া। বাংলাদেশের হেরে যাওয়া। বাংলাদেশ এখন আর হারার পর্যায়ে নেই।

২০২৪ সালের নির্বাচন তরুণদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে যদি উন্নয়নের পথে রাখতে হয় তাহলে তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। তরুণ সমাজের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে পরবর্তী বাংলাদেশ। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তরুণ সমাজ কখনও ভুল করেনি। তরুণ সমাজ কখনও ভুল করে না। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের বিপুল বিজয়ের কারণ ছিল তরুণ সমাজ। সেবার আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছিল ২৩০ টি আসন। এর অন্যতম কারণ প্রায় ২ কোটি নতুন ভোটার। বাংলাদেশের তরুণেরা সেবার নির্বাচনে ভোট দিয়ে বিজয়ের উৎসব করেছিলেন।

১০ বছর পর নতুন ভোটার হয় প্রায় ২ কোটি ২৫ লক্ষ। সেবারও অর্থাৎ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল এবং ২৫৭টি আসন লাভ করেছিল। সে সময় বাংলাদেশে মোট ভোটার ছিল ১০ কোটি ৪১ লাখের বেশি। ২০২৩ সালের তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯১ লাখেরও বেশি। যার মধ্যে প্রথম ভোটার বা প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন প্রায় দেড় কোটি মানুষ। এই দেড় কোটি নতুন ভোটার এবং তরুণ ভোটারদের ওপর দ্বাদশ সংসদে কারা নির্বাচিত হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে। কারণ তরুণদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি সব সময়ই বেশি থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।

কিন্তু ২০১৪ সালের মতো এবারও বিএনপি অগ্নি সন্ত্রাস শুরু করেছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের জীবিকা অর্জনের বাহনগুলো। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে তারা ব্যহত করতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু গত কয়েকদিনের হরতাল অবরোধে দূরপাল্লার বাস কম গেলেও ঢাকা শহরের যানজটই বলে দেয় মানুষ আর বিএনপির মধ্যযুগীয় রাজনীতির পক্ষে নেই। মানুষকে ঘুম থেকে উঠে নিজের টাকা দিয়েই বাজার করতে হয়। বিএনপি তাদের দায়িত্ব নেবে না। মানুষকে জীবিকার জন্য কর্মস্থলে যেতেই হবে। এজন্য কেউ আর ঘরে বসে নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

এই ব্যস্ততা একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ব্যস্ততা। সমৃদ্ধ হওয়ার পথের ব্যস্ততা। দেশতো একটি মানচিত্র। দেশের মানুষকে নিয়েই দেশ। দেশের মানুষের যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হয় তাহলে দেশ এগোতে পারে না। আর দেশনেতার কাজ মানুষের জীবনকে মসৃণ করা। মানুষের জীবন-যাপনকে সহজ করা। গত ১৫ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের জীবনকে কীভাবে মসৃণ করা যায় তারই সাধনা করছেন। সেখানে তিনি সফলও হয়েছেন। বাংলাদেশের দৃশ্যমান উন্নয়নগুলোই তার প্রমাণ।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে ৫০ বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে একটি সেতুর জন্য। পদ্মা সেতুর জন্য। বঙ্গবন্ধু যে সেতুর স্বপ্ন বুনেছিলেন। আগে মানুষকে বরিশাল যেতে যেখানে সারারাত লাগত সেখানে ৩ ঘণ্টায় পদ্মাসেতু দিয়ে মানুষ ঘরে ফিরে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার মানুষে জীবনকে সহজ করে দিয়েছে পদ্মাসেতু। সড়ক ও রেলপথে মানুষ সহজেই ঘরে ফিরে যেতে পারছে।

আবার ঢাকায় ফিরতে পারছে। কৃষক তার ফসল সহজেই বাজারজাত করতে পারছে। নদীকে রক্ষা করে, নদীকে স্পর্শ না করেও কীভাবে নদী পার হওয়া যায় তা এখন বাংলাদেশের মানুষ জানে। চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। ঢাকা শহর পৃথিবী অন্যতম বৃহৎ মেগাসিটি। এখানে যানজট মানুষের নিত্যসঙ্গী। সেই শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে এখন ৩৬ মিনিট সময় লাগে। যেটি বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলেই কারণেই সম্ভব হয়েছে।

এ অবস্থায় অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে, যা এক সময়ে এই শহরের যানজটের অন্যতম কারণও ছিল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অর্ধেকের মতো চালু হয়েছে আর তাতেই যানজট অনেকটাই কমেছে। পুরোটা চালু হলে ঢাকার বাইরে যাওয়া গাড়িগুলোকে আর মাটির সড়ক স্পর্শ করতে হবে না। তখন যানজট আরও কমে আসবে। ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-বেনাপোল, ঢাকা-খুলনা এই তিনটি নতুন ট্রেন ও দুটি রুটও বাংলাদেশের বদলে যাওয়া ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্মারক। এক সময় তারেক রহমানকে মানুষ ‘খাম্বা তারেক’ বলতেন। কারণ আমরা সবাই জানি। বিদ্যুৎ। খুঁটি। বিদ্যুতের খুঁটি।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন কম ছিল। অনেক ছোট ছোট শহরেও বিদ্যুৎ ছিল না। যাও বা ছিল তাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ কম ছিল। বিদ্যুৎ একবার চলে গেলে কখন আসবে কেউ জানত না। এখন গ্রাম ও শহর বলতে আলাদা কিছু নেই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ১০০ ভাগ মানুষ এর সুফল পায়। এই বাংলাদেশ ১৫ বছর আগে ছিল না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো সফল করা সম্ভব হয়েছে। আর সেই সুযোগ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যাকেই বার বার বেছে নিয়েছেন। আর এ ধারা অব্যহত থাকলে ২০৪১ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জন করা সম্ভব হবে। গণতন্ত্রে জনগণই সবকিছু। জনগণই ঠিক করবেন তারা কাকে ক্ষমতায় দেখতে চান।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থাশীল। কারণ তারাই তাকে বারবার ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তার সুফলও বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছেন। এবার বাংলাদেশের সব জনগণের মতো তরুণ সমাজ ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় উদযাপন করবে।

লেখক: অধ্যাপক; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল); সভাপতি, এডুকেশন, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম, বাংলাদেশ (ইআরডিএফবি); সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে