গোল্ডেন এ প্লাসের ভবিষ্যৎ কী?

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৩; সময়: ১১:২১ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
গোল্ডেন এ প্লাসের ভবিষ্যৎ কী?

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল ২৬ নভেম্বর ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়েছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের যারা এই পরীক্ষায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করল তাদের অভিনন্দন। তাদের অনেকের মধ্যেই আনন্দের বন্যা।

২০২৩ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৭৮.৬৪ শতাংশ। ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের ২০২২ সালের চেয়ে এবার পাসের হার কমেছে ৭.৩১ শতাংশ। ২০২২ সালে পাসের গড় হার ছিল ৮৫.৯৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের ছাত্রীদের পাসের হার ৮০.৫৭ শতাংশ, ছাত্রদের পাসের হার ৭৬.৭৬ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৩৬৫ শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পাওয়ার হার প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।

২০২৩ সালে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৯.৪৪ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৮০.৬৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭৩.৮১ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৭৫.৩৪ শতাংশ ও রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৭৮.৪৫ শতাংশ। প্রতিটি বোর্ডেই পাসের হার উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমেছে।

প্রশ্ন হলো, এবার যেসব শিক্ষার্থী গোল্ডেন এ বা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে এবং যারা আজ তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত-তাদের সামনের গন্তব্য কী? কী করবে তারা? এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশ অবশ্যই উচ্চশিক্ষার পথ বেছে নেবেন। উচ্চশিক্ষার পথগুলোর মধ্যে প্রধানত তারা মেডিকেল কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাবেন।

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন সংখ্যা প্রায় ৫২ হাজার। ২০২৩ সালে কেবল জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীই কাঙ্ক্ষিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চান্স পাবেন? অবশ্যই নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী কম জিপিএ পেয়েও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেননি বা এবারেও পারবেন না বলেই ধারণা করা যায়।

যেসব শিক্ষার্থী এবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন না, তাদের তো বাধ্য হয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকতে হবে….

তাহলে প্রশ্ন হলো, যেসব শিক্ষার্থী এবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন না, তাদের তো বাধ্য হয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকতে হবে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভর্তিতে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এই কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলোয় ভর্তি হন। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের। এছাড়া কলেজগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার ও শিক্ষকের অনুপাত খুবই শোচনীয়। শত শত শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক, ছোট ক্লাসরুম অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় মনোযোগ কমায় এবং ক্লাস বিমুখ করে তোলে। সব মিলিয়ে উচ্চশিক্ষা শুধুমাত্র নামেই থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছেন তার বিপরীতে চাকরির বাজার বেশ অপ্রতুল। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২১ সালের এক জরিপের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন।

যেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরও চাকরি জীবনে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা, আবার যেখানে পর্যাপ্ত দক্ষতা, যোগ্যতার অভাব থেকে যাচ্ছে; সেই জায়গায় উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী (যুগান্তর, ২০২২) কর্মজীবনে প্রবেশ করছেন তাদের অবস্থা কী হবে? আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস, পঠন, শিক্ষণের পরিবেশ কি দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরিতে সক্ষম?

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও যুগোপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি, কৌশল ঠিক করা যায়নি। একটি শিক্ষা পদ্ধতি শুরু করার কয়েকদিনের মধ্যেই আবারও পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে দিয়েছে। নতুন নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হা হুতাশ বাড়ছে।

শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন এমন অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি গাইড, নোট ও কোচিং–নির্ভর হয়েছেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন অভিভাবকেরাও।

২০২২ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৮৪.৯ শতাংশ যুবক-যুবতীর প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতার অভাব রয়েছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলছে, কর্মক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ বাড়ার ফলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ কর্মীকে নিজের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। এই পরিস্থিতি সামলাতে কারিগরি শিক্ষার বিশেষ ভূমিকা থাকলেও এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে এই শিক্ষা অবহেলিত। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি জনপ্রিয় করা যায়নি। প্রযুক্তিগত দক্ষতাতেও অনেক পিছিয়ে শিক্ষার্থীরা।

২০২২ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৮৪.৯ শতাংশ যুবক-যুবতীর প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতার অভাব রয়েছে। কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় মাধ্যমিক স্তরের দক্ষতা থেকে বঞ্চিত ৫৭.৮ শতাংশ যুবক-যুবতী। সব মিলিয়ে একুশ শতকের বাকি সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এই অবস্থা কোনোভাবেই দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দেয় না।

দেশের জনগণকে গুণগত, যথাযথ জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা না গেলে বিশ্ববাজার-নির্ভর টেকসই দক্ষতা প্রদান সম্ভব হবে না। এর প্রভাব পড়বে দেশের সার্বিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে।

বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা বিনির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরসর কাজ করে যাচ্ছেন। আর এই সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে দিতে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছেন। তবে, স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি। এক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

শুধু পরিমাণ বৃদ্ধি নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমেই প্রযুক্তি নিভর এই বিশ্বে তাল মিলিয়ে চলার মতো জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকে যেমন শিক্ষা বাজেট বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে, আবার অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে এই স্তরকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে