রমজানে নারীরা যেসব আমলে মনোযোগী হবেন
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : রমজানকে বলা হয় সাইয়িদুশ শুহুর বা সকল মাসের সেরা মাস। এ মাসের প্রত্যেকটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। রমজানের রোজা ফরজ এবং এর এতটাই ফজিলত যে মহান আল্লাহ এর পুরস্কার নিজ হাতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (মুসলিম: ২৭৬০)
‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করবে, সে আজীবন সেই রোজার (ক্ষতিপূরণ) আদায় করতে পারবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৯৮৭৮)
পবিত্র রমজানে রোজা রাখা ছাড়াও এমন কিছু আমল আছে যেগুলোর ফজিলত অনেক বেশি। যা নারী-পুরুষ সবার জন্য প্রযোজ্য। আবার নারীদেরও কিছু করণীয় ও বর্জনীয় রয়েছে। রোজার দিনগুলো সাধারণত নারীদের ঘরোয়া পরিবেশেই কাটে। তাদের পক্ষে রমজানের বরকত হাসিল করা অনেকাংশে সহজ। তাই তাদের উচিত, রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে জীবনের সফলতার দ্বার উন্মোচন করা। রমজানে নারীর বিশেষ কিছু আমল কোরআন-হাদিসের আলোকে এখানে তুলে ধরা হলো—
যথাযথভাবে নামাজ আদায় করা
রোজাই হচ্ছে রমজানের প্রধান ইবাদত। রোজা রাখার ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে— এটা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু অনেকেই আছেন রোজা রাখেন কিন্তু নামাজ ঠিকমতো পড়েন না— এটা খুবই অন্যায়। অন্য সময় তো নামাজ পড়বেনই, রমজানে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়বেন এবং যথাযথভাবে পড়বেন। তাছাড়া অন্যান্য ইবাদতের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে হবে। ইসলাম নারীদের জন্য জান্নাত লাভের পথ একদম সহজ করে দিয়েছে।
এক হাদিসে আছে, চারটি আমল করলে আল্লাহ তাআলা তাদের জান্নাতে পৌঁছে দেবেন। যেকোনো দরজা দিয়ে তারা জান্নাতে যেতে পারবে। এক. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। দুই. রমজানের রোজা। তিন. লজ্জাস্থানের হেফাজত। চার. স্বামীর আনুগত্য। এই চারটি আমলের বিনিময়ে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৪১৬৩; মুসনাদে আহমদ: ১৬৬১)
বাকসংযম জরুরি
পরচর্চা, কুৎসা, নিরর্থক বিষয় নিয়ে মাতামাতি বন্ধ করতে হবে। এগুলো রোজার জন্য খুবই ক্ষতিকারক। না খেয়ে উপোস থাকা যেমন রোজার অংশ তেমনি বাকসংযমও। তাই রমজানে নারীর উচিত হলো, যথাসম্ভব বাকসংযম করা। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে প্রশ্ন করা হলো—কোন কর্মটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, আল্লাহভীতি, সদাচার ও উত্তম চরিত্র। আবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তিরমিজি: ২০০৪)
চালচলনে শালীন হওয়া
চলাফেরা ও চালচলনে শালীন হতে হবে। নারীর খোলামেলা চালচলন তাদের নিজেদের রোজার পবিত্রতার জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি পরপুরুষের রোজা নষ্ট কিংবা হালকা করার জন্যও দায়ী। এজন্য রমজানের দিনে নারীর বাইরে বের হতে হলে শালীনতার সঙ্গে বের হওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করো, প্রাচীন অজ্ঞতার যুগের মতো চোখ ঝলসানো প্রদর্শনী করে বেড়িও না।’ (সুরা আহজাব: ৩৩)
দান-সদকা করা
যেকোনো সময়ের তুলনায় রমজানে দান-সদকার ফজিলত অনেক বেশি। এক্ষেত্রে নারীদের রয়েছে দারুণ সুযোগ। এর দ্বারা আল্লাহর বিশেষ কৃপা কুড়ানোর আশা করা যায়। নবী (স.) বলেন, ‘দান-সদকা গুনাহকে এমনভাবে মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে। (মুসনাদে আহমদ: ২২১৩৩)
আল্লাহর রাসুল (স.) আরও বলেন, ‘খেজুরের এক টুকরা দিয়ে হলেও (দান করে) নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।’ (বুখারি: ৭৫১২)
মেজাজ না হারানো এবং সুন্দর আচরণ করা
রোজা রাখলে ক্ষুধা লাগবে, পিপাসা পাবে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর প্রভাব যেন কোনোভাবেই আচরণে প্রকাশ না পায়। সাংসারিক কাজের ঝামেলার কারণে অনেক মহিলা রোজা রেখে মেজাজ খারাপ করে রাখেন। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর জন্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে মর্যাদাসিক্ত করেন। তখন সে নিজের চোখে তুচ্ছ হলেও মানুষের চোখে অনেক বড় বিবেচিত হয়।’ (বায়হাকি: ৭৭৯০)
অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকা
হাদিসে রোজাদারকে নিরর্থক কাজ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোজা রেখে অনেকের দিন কাটতে চায় না— এই অজুহাতে গান-বাজনা, ইন্টারনেট আসক্তিসহ বিভিন্ন আজেবাজে কাজে সময় ব্যয় করেন। কিন্তু এটা সমীচীন নয়। কেননা রোজাদারের সারাদিন হবে ইবাদতের শামিল। বাহ্যিক কোনো ইবাদত না করলেও তার ধ্যান-ধারণা থাকবে ইবাদতের প্রতি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অনর্থক কথা-কাজ পরিহার করা।’ (সুনানে তিরমিজি: ২৩১৭)
সংসারের প্রতি মনোযোগী হওয়া
বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে যেহেতু রমজানের রুটিন কিছুটা ভিন্ন, সেজন্য সাংসারিক কাজকর্ম কিংবা পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে—তা নিরসন করার দায়িত্ব নারীর ওপর। অন্যের সুবিধার কথা চিন্তা করে, নিজে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে হলেও সংসারের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
কোরআনের বর্ণনায় স্ত্রীর মূল দায়িত্ব হলো— স্বামীর সংসারের দেখাশোনা, তদারক করা ও স্বামীর সম্পদ হেফাজত করা এবং সন্তান প্রতিপালন করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীরা অনুগত এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহ যা সংরক্ষিত করেছেন, তা হেফাজত করে।’ (সুরা নিসা: ৩৪)
কোরআন তেলাওয়াত করা
রমজান হচ্ছে কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসের সঙ্গে কোরআনের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের সওয়াব অনেক বেশি। যারা কোরআন পড়তে পারেন তারা বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করবেন। আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস— যার মধ্যে কোরআন নাজিল করা হয়েছে লোকদের পথপ্রদর্শক এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)
আবু উমামা বাহিলি (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেন, ‘ তোমরা কোরআন পড়ো, কেননা তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন সুপারিশকারী হিসেবে আসবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪)
সহিহ ইবনে হিব্বানে এসেছে, ‘কোরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ কবুল করা হবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পথপ্রদর্শক বানাবে কোরআন তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি কোরআনকে পশ্চাতে ফেলে রাখবে কোরআন তাকে জাহান্নামে পাঠাবে।’ (ইবনে হিব্বান: ১২৪)
ইতেকাফ করা
ইতেকাফ রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল। নারীরাও ইচ্ছে করলে শেষ দশকে ইতেকাফ করতে পারেন। তবে তা অন্দরমহলে পূর্ণ পর্দা বজায় রেখে। এর দ্বারা রমজানের দাবি যেমন ভালোভাবে আদায় করা যায় তেমনি মহিমান্বিত রাত শবেকদরের বরকত লাভে ধন্য হওয়া যায়। হাদিসে আছে, ‘রাসুল (স.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। এরপর তাঁর পবিত্র স্ত্রীরা ইতেকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২৭১)
আরেক হাদিসে নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যার দূরত্ব দুই দিগন্তের দূরত্বের থেকে বেশি দূরত্ব হবে।’ (কানযুল উম্মাল: ২৪০১৯)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব নারীকে রমজান মাসে উল্লেখিত বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।