চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলোচিত জেম হত্যায় ৫ আসামির স্বীকারোক্তি

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৩; সময়: ১:৩৭ অপরাহ্ণ |
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলোচিত জেম হত্যায় ৫ আসামির স্বীকারোক্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক : চাঁপাইনবাবগঞ্জে আলোচিত যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম ওরফে জেম (৪৮) হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার পাঁচ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বুধবার বিকেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমলি আদালতের বিচারক হুমায়ন কবীরের কাছে ১৬৪ ধারায় তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

স্বীকারোক্তি দেওয়া পাঁচ আসামি হলেন, জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেসবাউল হক (৪২), চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মসজিদপাড়া মহল্লার মাসুদ রানা (৩৮), ইব্রাহিম ওরফে দাউদ ইব্রাহিম (৩২), হুজরাপুর রেলবাগান মহল্লার শামীম রেজা (৩৫) ও প্রান্তিক পাড়া মহল্লার মিলন হোসেন (৩০)।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আদালতে জবানবন্দি রেকর্ড করার পর আসামিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। স্বীকারোক্তি দেওয়া পাঁচ আসামি গত সোমবার থেকে তিন দিনের রিমান্ডে ছিলেন। তাদের দেয়া জবানবন্দি খতিয়ে দেখা হবে।

গত ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উদয়ন মোড় এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খাইরুল আলম জেম নিহত হন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের সাবেক সহশ্রমবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তার বাড়ি শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দনা গ্রামে হলেও তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের নয়াগোলা এলাকায় বসবাস করতেন।

জেম হত্যাকান্ডের ঘটনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য মোখলেসুর রহমান, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের গত উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য প্রার্থী সামিউল হক লিটনসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন নিহত ব্যক্তির ভাই মনিরুল ইসলাম। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ২০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, নিহত খাইরুল আলম জেম পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে খুন পাল্টা খুন, বোমাবাজি, প্রতিপক্ষের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অপরাধে জেমের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। এলাকায় মোমারু জেম নামে পরিচিত খাইরুল আলম জেম সাইফুদ্দিন আহমেদ সাফু হত্যার মুলহোতা ছিলেন। ২০২০ সালের ১৪ জুন জেম ও তার ক্যাডার বাহিনী সাফুকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

এছাড়াও শিবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আব্দুস সালামের সঙ্গে জেমের দুই যুগের বেশী সময় ধরে রেষারেষি চলে আসছিল। বছর দুয়েক আগে সাফু খুন ও সালাম মারা যাওয়ার পর জেম নিজ এলাকা ছেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আশ্রয় নেন। খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের শেল্টারে ছিলেন।

সূত্রমতে, জেম নিজ এলাকা ছেড়ে শহরে আসলেও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ত্যাগ করতে পারেননি। এমপির প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গড় তোলেন নিজস্ব বাহিনী। গত ১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনে হওয়া উপ-নির্বাচনের আগে ও পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আধিপত্য বিস্তারে এসব ঘটনান নেতৃত্বে ছিলেন জেম।

এছাড়াও গত ৫ ডিসেম্বর পৌরসভা পার্ক মাঠে জেলা কৃষক লীগের সম্মেলনে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। এমপি ও মেয়র অনুসারীদের মধ্যে ওই সংঘর্ষের সময় বোমাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন জেম। এসবকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে পোস্ট ও পাল্টা হুমকিমূলক পোস্ট দিতেন জেম। খুন হওয়ার একদিন আগে জেম হুমকি দিয়ে ফেসবুকে একটি লাইভ করেন।

এদিকে, জেম হত্যাকান্ড রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শহরের মধ্যে ঘটলেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে জেলাজুড়ে। বিশেষ করে মামলায় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ হাট-ঘাট মালিক, বালু ব্যবসায়ী, শিক্ষক-ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে আসামি হয়েছেন। যারা গত উপ-নির্বাচনে স্থানীয় এমপি আব্দুল ওদুদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, জেম হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা তার বিরোধী পক্ষের লোকেদের আসামি করেছেন। এমপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য মোখলেসুর রহমানের মালিকানাধীন গ্রামীণ ট্রাভেলসের জিএম ও জেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি আসাদুজ্জামান ছানা ও গ্রামীন ট্রাভেলসের কাউন্টার ম্যানেজার শামসুল হোদা সনি, মোখলেসুর রহমানের অনুসারী রানীহাটি ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলী, চর বাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদ রানা টিপু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অব্দুল কাদেরসহ এমন সব লোকেদের আসামি করা হয়েছে যারা জেমকে চিনতেনও না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল জলিল বলেন, যে কোন হত্যাকান্ড বেদনার। কিন্তু জেম হত্যায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জেলাজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষকে আসামি করেছেন। দলের ভেতরে ও বাইরে যারা গত উপ-নির্বাচনে এমপি ওদুদ বিপক্ষে ছিলেন তাদের অনেকেই জেম হত্যার আসামি হয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি দলের কেন্দ্রকে লিখিতভাবে জানানো হবে।

এসব বিষয় নিয়ে গত ২১ এপ্রিল জেম হত্যার প্রতিবাদে ডাকা মানববন্ধনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বলেছিলেন, ‘জেম কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন না। জেমকে হত্যা করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা প্রতিশোধ নিয়েছে। কারণ জেম উপ-নির্বাচনে তার হয়ে কাজ করেছিলেন। এছাড়াও জেম হত্যায় তার ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এখানে তিনি কোন প্রভাব খাটায়নি বা কাউকে আসামী করতে বলিনি।’

ঘটনার দুইদিন পর সংবাদ সম্মেলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব বলেছিলেন, বাদী যেভাবে এজাহার দেন সেটাকেই মামলা আকারে রেকর্ড করতে হয়। তবে তদন্তের পর আমরা বলতে পারব কারা অভিযুক্ত আর কারা নির্দোষ। তদন্ত করে হত্যাকান্ডের কারণ উদঘাটন ও এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। খুব শ্রীঘ্রই সেটি বের করে দোষিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে