বদলগাছীতে ইজারা ছাড়াই রাতের বেলায় নদীর মাটি ও বালু লুট

প্রকাশিত: মে ২১, ২০২৩; সময়: ১:৪৮ অপরাহ্ণ |
বদলগাছীতে ইজারা ছাড়াই রাতের বেলায় নদীর মাটি ও বালু লুট

নিজস্ব প্রতিবেদক, বদলগাছী : নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার দেউলিয়া এলাকায় রাতের বেলায় ছোট যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে মাটি ও বালু তুলে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরত কুমারসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের আরও তিন জন সাবেক ও বর্তমান নেতার বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে উত্তোলন করা এসব বালু কোটি টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে।

আর ইজারা না নিয়ে যত্রতত্র বালু তোলায় ভাঙনের মুখে পড়েছে নদীর বাঁধ ও তীরবর্তী এলাকা। নদী ও নদীতীরবর্তী জনপদ রক্ষায় দ্রুত বালু তোলা বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।

জেলা প্রশাসক কাযালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের (১৪২৯ সন) ৯ মার্চ নওগাঁয় আটটি বালুমহাল সরকারিভাবে ইজারা দেয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। যেখানে বদলগাছী উপজেলার ছোট যমুনা নদীর ৭১ দশমিক ৫৭ একর বালুমহালের সরকারি ইজারামূল্য ধরা হয় ৩৯ লাখ ২৫২ টাকা।

কার্যাদেশ অনুসারে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ৬২ লাখ ৩১ হাজার ৭১১ টাকায় বালুমহালের ইজারা পান বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তপন কুমার মন্ডল। বালু উত্তোলনে তাকে ১০টি মৌজা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে তেজাপাড়া মৌজায় রয়েছে ১ দশমিক ৭৭ একর।

বদলগাছী উপজেলার দেউলিয়া ও তেজাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ১৪২৯ সনে তেজাপাড়া মৌজায় ১ দশমিক ৭৭ একর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে প্রায় ৩০ একর এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। নদীতে পানি থাকা অবস্থায় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত হয় ড্রেজার। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে বালু কাটতে ব্যবহৃত হচ্ছে এক্সেভেটর। এতে নদীতীরবর্তী বেশকিছু স্থানে ফসলি জমি ধসে পড়েছে। কোথাও ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

চলতি বছর ওই নদীতে উত্তোলনযোগ্য বালু নেই বলে একটি প্রতিবেদন পাঠায় উপজেলা প্রশাসন। যার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর নদীর বালুমহাল ইজারা দেয়া হয়নি।

অনুমোদন ও ইজারা ছাড়াই এভাবে অবাধে ছোট যমুনা নদী থেকে বালু তুলছেন বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তপন কুমার মন্ডল, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরথ কুমার। তাদের নেতৃত্বেই বড় একটি বাহিনী কাজ করছে মাঠে। মাঠ পর্যায়ে ব্যবসাটি তদারকিতে কাজ করছেন বদলগাছী উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি সানাউল হোসেন হিরো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন বালু ব্যবসায়ী বলেন, গত বছর বালুমহাল ইজারা নিয়ে নির্ধারিত মৌজার প্রত্যেকটি এলাকা ছাড়িয়ে অবৈধ পয়েন্ট খুলে বসেন ইজারাদার তপন। বালু উত্তোলনের সময় পেরিয়ে গেলেও দেউলিয়া-তাজপুরে প্রায় ৩০ একর এলাকা থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেন তিনি। কয়েক কোটি টাকার বালু অবৈধভাবে বিক্রির পর তাকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে উপজেলা প্রশাসন। নিয়মিত মামলা করার সুযোগ থাকলেও তা করেননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হঠাৎ করেই মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেউলিয়া এলাকায় ছোট যমুনা নদীতে মাটিকাটার খননযন্ত্র আনা হয়। সন্ধ্যা সাতটার পর থেকে সেখানে ট্র্যাক্টর আসতে শুরু করে। ৩০-৪০ টি ট্র্যাক্টর সারা রাত বিরতিহীনভাবে নদীর মাটি ও বালু নিয়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে একইভাবে রাতে বেলা মাটি ও বালু কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। দিনের বেলায় মাটি ও বালু কাটা বন্ধ থাকছে।

গভীর গর্ত করে নদীর চরের মাটি ও বালু তোলায় নদীতীরবর্তী ফসলি জমি ধসের ঝুঁকিতে পড়েছে। বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরত কুমারসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান আরও তিন নেতা এই মাটি ও বালু তোলার কাজ করছেন। ভয়ে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেন না।

গভীর নদীর মাটি ও বালু তোলার স্থানের ওপর ২৬ শতক ফসলি জমিতে লাউয়ের আবাদ করছেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন,গভীর করে নদীর মাটি ও বালু তোলায় একটু ভারী বৃষ্টিতে আমার জমি ধসে পড়বে। মাটি ও বালু উত্তোলনকারীরা সবাই সরকার দলীয় নেতা। কেউ কিছু বললে তাঁরা মামলা দিয়ে হয়রানীর হুমকি দেন। একারণে ভয়ে কেউ কিছু বলেন না।

আধাইপুর ইউনিয়নের দেউলিয়া ও তেজপাড়া মৌজায় ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী জমি পত্তনী নিয়ে দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত চাষাবাদ করে আসছেন মজিবর রহমান, নুরুল ইসলামসহ প্রায় ২৭ কৃষক। তারা বলেন, ‘সরকার আমাদের ফসল আবাদ করতে এ জমি দিয়েছে। সেই জমি পুরোটাই নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে জমির একাংশ এরই মধ্যে ধসে গেছে। প্রশাসন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে আছে।’

দেউলিয়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা তপন ইজারার সময় পেরিয়ে গেলেও বালু উত্তোলন বন্ধ রাখেননি। বালু মহালের নির্ধারিত স্থান থেকে বালু না কেটে যত্রতত্র মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে।

অবশ্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরত কুমার নদীর মাটি ও বালু তোলার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা গত বছর বালুমহাল ইজারা নিয়েছিলাম। প্রশাসন আমাদেরকে নদীর দুটি পয়েন্ট বুঝে দিতে পারেনি। একারণে আমরা ব্যবসায়ীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এব্যাপারে হাইকোটে রীট পিটিশন করেছি। নওগাঁর জেলা প্রশাসক ও বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অনুমতি নিয়ে বালু তুলছি। তবে বর্ষার কারণে এখন বালু তোলা হয়নি’।

উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি সানাউল হোসেন হিরো বলেন, তপন কুমার আমাদের ব্যবসায়িক পার্টনার। সওজের সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে এবার কোটি টাকার বালু লাগছে। একজনের মধ্যস্থতায় ছোট যমুনা থেকে কিছু বালু উত্তোলন করে সেখানে বিক্রি করা হয়েছে। বৈশাখের পর তেজাপাড়া থেকে উত্তোলন করা বালু ইউএনও স্যারের একটি প্রকল্পে পাঠিয়েছি। উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেকেই আমাদের বালু ব্যবসায় সম্পৃক্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক তপন কুমার মন্ডল তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি বা আমার ব্যবসায়িক পার্টনারদের কেউই নির্ধারিত স্থানের বাইরে বালু উত্তোলন করিনি। বৈশাখ মাসের পর আর বালু উত্তোলন হচ্ছে না। বালু মহাল ইজারা নিয়ে গত বছর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাইকোর্টে রিট করেছি।

বদলগাছীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বলেন, উপজেলায় ছোট যমুনা নদীর বালু মহাল কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। স্থানীয় কয়েক জন বালু ব্যবসায়ী হাইকোটে রীট করেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। তাঁদেরকে রীটের কাগজপত্র দেখাতে বলেছি। তাঁরা কেউ আমাকে রীটের কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। আমি ও ডিসি স্যার কাউকে নদী থেকে বালু তোলার অনুমতি দেইনি। রাতের বেলায় দেউলিয়া এলাকায় ছোট যমুনা নদীর বালু কেটে বিক্রি করা হচ্ছে এমন খবর জানার তা বন্ধ করতে বলেছি। এরপর যদি কেউ অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, বালু মহাল ইজারার ক্ষেত্রে কোন জায়গা থেকে কীভাবে বালু তুলতে হবে সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এটি ভঙ্গ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। বদলগাছী বালু মহালে উত্তোলনযোগ্য বালু না থাকায় এ বছর ইজারা দেয়া হয়নি। ইজারা ব্যতীত কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে