ভোটের দ্বারপ্রান্তে এসে আরও কঠোর ইসি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৪; সময়: ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ |
ভোটের দ্বারপ্রান্তে এসে আরও কঠোর ইসি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ভোট গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে এসে আরও হার্ডলাইনে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটের মাত্র দুদিন আগে গতকাল বৃহস্পতিবার ৪২ প্রার্থী ও তাদের সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আরও কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছে সংস্থাটি। এর আগে ইসির নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা করা হয়েছে।

এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং ভোটের দিনের পরিবেশ ঠিক রাখতেই কমিশনের এমন কঠোর অবস্থান বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের অন্তত ৫৯০টি নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। শোকজ, তলব ও জরিমানাও করা হয় অনেককে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও রয়েছেন। এরপর বেপরোয়া প্রার্থীদের লাগাম টানতে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। যদিও পরদিন উচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রার্থিতা ফেরত পেয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন সেই প্রার্থী।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক শোকজ, তলব, সতর্ক ও জরিমানার পরও প্রার্থীদের বাগে আনতে পারছে না ইসি। কমিশনের রক্তচক্ষুর আড়ালে সারা দেশে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হুমকি-ধমকি, হামলা, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাসহ নানাভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন বেপরোয়া প্রার্থীরা। গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

ভোটের সময় ঘনিয়ে আসায় পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে নানা মহল থেকে। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেষ সময়ে এসে প্রায় অর্ধশত প্রার্থী ও তাদের সমর্থক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। গতকালই এসব চিঠি নিজ নিজ এলাকার নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর দীর্ঘদিনের চাপ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর। নির্বাচন কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতিও চালু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে ভোটের পর আরও নতুন নতুন পদক্ষেপের গুঞ্জন রয়েছে বিভিন্ন মহলে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের বক্তব্যেও ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নানা শঙ্কার কথা ফুটে উঠেছে। কিন্তু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ভোটে না আসায় শুরুতেই অংশগ্রহণমূলক ভোটের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় সারা দেশে যেমন ভোটে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে তেমনি নির্বাচনী সহিংসতাও দৃশ্যমান হয়েছেন।

নির্বাচনী প্রচারে একে অন্যকে ঘায়েল করতে নানাভাবে বিষোদ্গার করছেন প্রার্থীরা। শুধু তাই নয়, প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে হুমকি-ধমকি, সহিংসতা এবং নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন নিহত এবং আরও বহু মানুষ আহত হন।

ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্য অনুসারে, তপশিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত যে ৫৯০ প্রার্থী ও সমর্থককে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়। তার মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তাদের মধ্যে আবার অন্তত শতাধিক বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির ৩০ জন ও অর্ধশতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও শোকজ করা হয়েছে। নোটিশ পাওয়া বাকিদের মধ্যে আছেন দলের কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এই তালিকায়ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক বেশি। বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে ইসির নির্দেশে ঝিনাইদহ-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল হাই ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত আদালতে ৯টি মামলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের আলোচিত দুই প্রার্থী কুমিল্লা-৬ আসনের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও বরগুনা-১ আসনের ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে নির্বাচন কমিশনে ডেকে যথাক্রমে ১ লাখ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে শেষবারের মতো সতর্ক করা হয়েছে।

বেপরোয়া প্রার্থীদের লাগাম টানতে গতকাল আরও ৪২ জনের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছে ইসি। এর মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিমা আহমাদের সমর্থক শিপন সরকার, আব্দুল আউয়াল, নয়ন গাজী ও বুলবুল। আর সেলিমা আহমাদকে জরিমানার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম ফারুক পিংকুর নির্বাচনী এজেন্ট কাশেম চৌধুরী, নোয়াখালী-২ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোরশেদ আলম এবং তার সমর্থক গিয়াস উদ্দীন, আব্দুল হক, জাহাঙ্গীর, আরমান হোসেন রকি, ফখরুদ্দীন রাজু, সোহরাব সুমন ও মনির আহমদ, নওগাঁ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাহিদ মোর্শেদ, লালমনিরহাট-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ১৯ সমর্থক, মাগুরা-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মুরাদ আলী,

মেহেরপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, কুষ্টিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ কৌশিক আহম্মেদ, যশোরের কেশবপুর ৭ নম্বর পাজিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান জসীম উদ্দীন, ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মান্নান গাজী ও কামরুল ইসলাম। চাঁদপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া মামলার তালিকায় আরও রয়েছেন কুমিল্লার বাহাউদ্দীন বাহারের সমর্থক ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমিনুল ইকরাম, নরসিংদী-১ আসনের সিরাজুল ইসলাম ও আজগর আলী, গাজীপুর-৫ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেহের আফরোজ চুমকির এপিএস মাজেদুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আলী আসলাম ও শফিকুল ইসলাম, জয়পুরহাটের ভাদসা ইউপি চেয়ারম্যান সারোয়ার হোসেন স্বাধীন, সুজাইত ও কামরুল, পাবনা-৩ আসনের ভাংগুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নুর ইসলাম মিন্টু, সিরাজগঞ্জের বেলকুচির পৌর মেয়র সাজ্জাদুল হক রেজাসহ আরও তিনজন, জয়পুরহাট-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মাহফুজ চৌধুরী, মশিউর রহমান শামীম ও রাশেদ, এস আই টুটুলসহ আরও ১২ জন,

নাটোর-২ আসনের জহির উদ্দীন সিকদার ও মুসা, নেত্রকোনা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস আয়া রয়েছেন।

ইসির সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত দেওয়া ৫৯০ নোটিশের মধ্যে ৩৮৪ প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। ইসির অনুমোদন ও নথিতে উপস্থাপন হয়েছে ১২০টি এবং অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ১৫৪টি প্রতিবেদন। এ ছাড়া আরও ৯৩টির কার্যক্রম চলমান। ঢাকা অঞ্চলে ১৩১টি, রংপুর অঞ্চলে ৪০টি, কুমিল্লা অঞ্চলে ৮১টি, ফরিদপুর অঞ্চলে ২৪টি, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৩৮টি, সিলেট অঞ্চলে ২১টি, বরিশাল অঞ্চলে ২৮টি, খুলনায় ৫৯টি, রাজশাহী অঞ্চলে ১০৩টি ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৬৪টি নোটিশ দেওয়া হয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের।

ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে ২ হাজার ৭১৬ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়েন ৭৩১ জন। ১ হাজার ৯৮৫ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইসিতে ৫৬০টি আপিল আবেদন জমা পড়ে। আপিল শুনানির মধ্য দিয়ে ২৭৫ জন তাদের প্রার্থিতা ফিরে পান। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বাছাইয়ে বৈধ ৫ জনের প্রার্থিতা আপিলে বাতিল হয়ে যায়। আর ২৮৫টি আপিল আবেদন নামঞ্জুর করে ইসি। ফলে শেষ পর্যন্ত বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬০টিতে। নির্দিষ্ট দিনে মনোনয়ন প্রত্যাহার শেষে মোট প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৯৬ জনে।

এর মধ্যে ভোটে অংশগ্রহণকারী ২৭টি দলের বাইরে ৩৮২ স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছেন। পরে উচ্চ আদালত এবং আপিল বিভাগের রায়ে কয়েকজন প্রার্থিতা ফিরে পান এবং কয়েকজনের প্রার্থিতা বাতিলও হয়। এতে চূড়ান্ত প্রার্থীসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৭০ জনে। ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সারা দেশে একযোগে ভোট গ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে ওইদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপিসহ নিবন্ধিত ১৬টি রাজনৈতিক দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে মাঠে রয়েছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে