আমার নানাভাই ও তাঁর শিক্ষা

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২০; সময়: ১২:০৩ অপরাহ্ণ |
আমার নানাভাই ও তাঁর শিক্ষা

অনিন্দ্য মাহমুদ : একজন শিক্ষাবিদ, একজন সম্পাদক, একজন লেখক, একজন চিন্তাবিদ, একজন দেশপ্রেমিক, একজন মানবমিত্র, একজন সমাজ-পরিবর্তনকামী, একজন সমাজতান্ত্রিক, একজন নানা, একজন বাবা, একজন ভাই; তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় আমার নানা ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

নানার সঙ্গে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গেলে একটা পুরো বই লেখা হয়ে যাবে। একটা পত্রিকায় কয়েক শ শব্দের একটি রচনার মধ্যে পুরো অভিজ্ঞতা লেখা সম্ভব নয়। তবু আমি চেষ্টা করছি; এবং যতটুকু সম্ভব সংক্ষিপ্ত করেই লিখব।

ছোটবেলা থেকেই নানার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার। যখন আমি কেজি ওয়ানে ও টুতে পড়তাম, তখন মাঝেমধ্যেই নানার সঙ্গে রাতে ঘুমাতাম। একটা ঘটনা আমার মনে আছে, রমজান মাসে একদিন আমি নানার সঙ্গে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। প্রতি পাঁচ-দশ মিনিট পরপর আমি বিছানা থেকে উঠে দেখছিলাম সবাই সাহ্‌রির জন্য উঠেছিল কি না! আজকে প্রায় ২০ বছর পর যখন আমি নানাকে নিয়ে লিখছি, তখন বুঝতে পারছি যে নানা আসলে কতটা ধৈর্যশীল-মানবিক একজন মানুষ। ওই দিন আমি পাঁচ-দশ মিনিট পরপর উঠে নানাকে বিরক্ত করা সত্ত্বেও নানা কিছুই বলেননি আমাকে।

স্কুলে থাকতে নানা আমার মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আমাদের ইংরেজি সাহিত্য ক্লাসে শেকস্‌পিয়ার পড়ানো শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকে শেকস্‌পিয়ার পড়তে একদম ভালো লাগত না। ইংরেজি সাহিত্যে পরীক্ষার ফলও খুব ভালো হচ্ছিল না আমার। তারপর একদিন নানা নিজেই আমাকে শেকস্‌পিয়ার পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর থেকে ক্রমাগতভাবে শেকস্‌পিয়ারের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করল। অষ্টম শ্রেণিতে পুরো ক্লাসের মধ্যে আমি ইংরেজি সাহিত্যে সর্বাধিক নাম্বার পেয়েছিলাম।

আমি আজও মনে করি, আমার ফলের ওই উন্নতির জন্য আমার নানার অবদানই সর্বাধিক।

কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের চেয়েও নানার কাছ থেকে জীবনের অনেক বিষয়ে শিক্ষা পেয়েছি, এবং আমি মনে করি, সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নানা আমাকে শিখিয়েছেন নিজ জাতিকে ভালোবাসতে, মানুষকে ভালোবাসতে। আমার নানা একজন দেশপ্রেমিক এবং সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের একনিষ্ঠ অনুরাগী। আমাকে ‍তিনি শিখিয়েছেন যে একটা জাতি তখনই সমন্বিতভাবে বিকশিত হতে পারে, যখন সেই জাতির সর্বস্তরের মানুষ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণিসহ সব ভেদাভেদ পরিত্যাগ করে একসঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে পারে। ১৯৪৭ সালে যখন গোটা ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাগ হয়েছিল। বাঙালি জাতি একটা গভীর খাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও আমরা সেখান থেকে উঠতে পারিনি।

ভারতীয় রাজনীতিবিদ শশী থারুর দেখলাম বলেছেন, ‘এককালে মোট দেশীয় পণ্য ছিল গোটা বিশ্বের ২৩ শতাংশ, সেই ভারতবর্ষই আজ পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলের মধ্যে একটা। আমাদের প্রতিবেশী চীন আজ আমাদের চেয়ে অনেক উপরে এগিয়ে গেছে।’

১৯৪৭ সালের সেই দেশভাগের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বাঙালি জাতির ওপরে। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার মানচিত্রের মধ্য দিয়ে একটি কাল্পনিক রেখা এঁকে বাঙালিদের দুই ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলো হয়ে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো হয়ে যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা রাজ্য। বাংলা ভাগ হওয়াতে হাজার বছরের বাংলার অর্থনীতি, সংস্কৃতির ও ঐতিহ্যের যা সমৃদ্ধি ঘটেছিল, তার অনেকটাই ছারখার হয়ে গিয়েছিল। যে বাংলায় একসময় জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ, সেই বাংলায় ক্রমাগতভাবে জন্মেছে, দুর্নীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, শাসক শ্রেণি কর্তৃক অবিরাম শ্রেণিশোষণ।

নানা আমাকে মানুষকে ভালোবাসতেও শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন যে মানুষকে ভালোবাসতে হলে একটা মানবিক সমাজ গড়তে হবে, যেখানে মানুষের সব অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে সব মৌলিক চাহিদা। তার জন্য দরকার একটা আদর্শিক গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যক্রমে, আজকের পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র—দুটোরই চর্চায় চরম বিচ্যুতি ঘটেছে। সেই বিচ্যুতির কারণে বিশ্বে আজকে পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তিধরদের ক্রমাগত ক্ষমতা বেড়ে চলেছে। সেই শক্তিমানেরা আজ আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে, ব্রাজিলে, ভারতে, মিয়ানমারে এবং আরও অনেক দেশে তাদের প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।

আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। পুঁজিবাদী ও ফ্যাসিবাদীদের অনাচার নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদী-ফ্যাসিবাদী শক্তিসমূহ শত শত বছর ধরেই বিশ্বে বিরাজ করে আছে। আমরা বাঙালিরা বহুদিন ধরে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি। অত্যাচারী সেন রাজবংশ থেকে শুরু করে শের শাহের বিরুদ্ধে, আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। ১৯৭১ সালে যখন আমরা অবশেষে পেলাম একটি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র, তখনই বুঝে গিয়েছিলাম যে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য দরকার এমন একটি সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সবার আগে প্রতিষ্ঠা পাবে মানুষ এবং মানুষের সব মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে আমরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রসহ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা মিলে চারটি আদর্শকে মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক যে প্রায় অর্ধশতক পরেও আমরা সেই আদর্শ সমাজের ধারে–কাছেও আসতে পারিনি। এর কারণ হলো, আমরা আটকে পড়েছি অভ্যন্তরীণ শোষণ, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, দুর্নীতি ও বিভেদের মধ্যে। আজ বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমরাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফাঁদে আটকে পড়েছি।

কিন্তু তবু হাল ছাড়ব না আমরা। আমার নানাভাই কখনো চাইবেন না যে আমি সহজে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মেনে নিই। তাই যত দিন বেঁচে থাকব, আমার নানার শিক্ষাগুলো হারিয়ে যেতে দেব না।
শুভ জন্মদিন, নানাভাই; আপনার মানবিক শিক্ষায় আলোকিত হোক আমাদের আগামী।

সূত্র : প্রথম আলো

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে