পাতায় আগুন জ্বালো

প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২০; সময়: ১২:২৯ অপরাহ্ণ |
পাতায় আগুন জ্বালো

গোলাম ফারুক খান :

‘ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।’
— সুকান্ত ভট্টাচার্য

হ্যাঁ, শুকনো পাতায় আগুন জ্বালাবার কাজটিই করে আসছেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে। নিজের অন্তরের প্রণোদনায় — কবির আহবানের অপেক্ষা না করেই। অতন্দ্র মনোযোগ, অবিচল নিষ্ঠা ও বিরামহীন সক্রিয়তায়। কেন জ্বালছেন আগুন এভাবে? অন্তত দুটি উত্তর খুবই স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও জিজ্ঞাসু পাঠকদের মনোলোককে জ্ঞান ও যুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলতে এবং মানুষের প্রদীপ্ত চেতনার শিখায় এই মুনাফাশাসিত, বৈষম্যপীড়িত, ঘুণেধরা সমাজের পরতে পরতে জমে-থাকা জঞ্জালের স্তূপকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিতে। শিক্ষক, সাহিত্যসমালোচক, সমাজ-রাজনীতির বিশ্লেষক, সম্পাদক, প্রতিবাদী মননজীবী এবং আরো অনেক ভূমিকায় সক্রিয় থেকে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজের ব্রত পালন করে আসছেন। এই নিরলস অগ্নিব্রতী — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী — আজ চুরাশি বছরে পা রাখলেন।

শ্রেণিকক্ষে কয়েক বছর তাঁর কাছে পাঠ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সুবাদে একসময় অহঙ্কার করে বলতাম, আমি তাঁর ছাত্র। নামের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে শিক্ষার্থীমহলে তাঁর পরিচয় ‘সিক স্যার’ হিসেবে। ‘সিক স্যারে’র ছাত্র হওয়ার দাবি নিজেকে অন্যের কাছে সমীহের পাত্র করে তুলতে পারে বলে ভাবতাম। কিন্তু আজ মনে হয়, এরকম গর্বোদ্ধত দাবির কোনো মানে হয় না। তিনি তো সারা বাংলাদেশের — কারো একার নন। শিক্ষা কি শুধু শ্রেণিকক্ষেই হয়? প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের তিনি শিক্ষক। এসব প্রজন্মের প্রতিটি সদস্যই নিজেকে তাঁর শিক্ষার্থী বলে বিবেচনা করতে পারেন।

আমাদের সময়ের অন্য অনেকের মতো আমিও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম তাঁর ছাত্র হওয়ার বেশ আগেই। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় হাতে আসে উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকার একটি সংখ্যা। পাতা উলটাতে উলটাতে চোখে পড়ে একটি প্রবন্ধ যার শিরোনাম ‘কথাসাহিত্যে ভাবালুতা’ কিংবা এমনি একটা কিছু। লেখকের নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কী এক অদৃশ্য টানে এক দমে পড়ে ফেললাম সেই লেখা। কথাসাহিত্যের প্রতি নিজের আশৈশব আসক্তির কারণেই হয়তবা। কিন্তু লেখাটি পড়ে নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গ ঘটল আমার। বলা যায় হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল রীতিমতো। বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম, আমার পড়া সেই সময়ের জনপ্রিয় কিছু উপন্যাসের উপর শীতল ছুরি চালিয়েছেন লেখক। নির্মমভাবে কাটাছেঁড়া করে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ঘটনা ও চরিত্রের বিকাশে ভাবালুতা ও অতিনাটকীয়তার সংক্রমণ এইসব উপন্যাসের শৈল্পিক সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। যতদূর মনে পড়ে, আবুল মনসুর আহমদের ‘জীবন ক্ষুধা’, আবুল ফজলের ‘রাঙ্গা প্রভাত’ এবং আরো কয়েকজনের উপন্যাস লেখকের সমালোচনার ছুরিতে রক্তাক্ত হয়েছিল। এই বেদনার ঘোর কাটিয়ে উঠতে খানিকটা সময় লেগে যায় আমার। তবে কলেজে উঠে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয় আরো। পড়া হয়ে যায় এইসব বই: ‘অন্বেষণ’ (১৯৬৪), ‘দ্বিতীয় ভুবন’ (১৯৭৪), ‘নিরাশ্রয় গৃহী’ (১৯৭৪), ‘তাকিয়ে দেখি’ (১৯৭৪), ‘আরণ্যক দৃশ্যাবলী’ (১৯৭৫)। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত তাঁর কলাম ‘উপর-কাঠামোর ভেতরেই’ ততদিনে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ কলামের লোভেই উন্মুখ হয়ে থাকতাম ‘বিচিত্রা’র প্রতিটি সংখ্যার জন্য।

সত্তরের দশকের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে তাঁকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয় আমার। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তিনি পড়াতে শুরু করেন। এবং আবার সেই উপন্যাস। শিল্পরূপ হিসেবে উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশ এবং তার সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে আমার অস্বচ্ছ, নড়বড়ে ধারণা আবার হোঁচট খায় তাঁর ক্লাসে। নতুন উপলব্ধি জেগে ওঠে কথাসাহিত্য বিষয়ে। মার্কসীয় ধারায় সমাজ ও শ্রেণি-বিশ্লেষণমূলক সাহিত্য-বিবেচনায় বিশ্বাসী তিনি। কথাসাহিত্যের আলোচনাও করেছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকেই। একে একে তাঁর কাছে পড়ি জেন অস্টেন, এমিলি ব্রন্টি, চার্লস ডিকেন্স — এইসব লেখকের উপন্যাস। পরে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে জোসেফ কনরাড, ই এম ফর্স্টার আর ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাস। তাঁর অনুপম শিক্ষণশৈলীর কারণে প্রতিটি উপন্যাসের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠত ক্লাসে। প্রতিটি লেখকের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতসহ যাবতীয় বৈশিষ্ট্য গাঁথা হয়ে থাকত মনে। বিদ্যায়তনে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যসমালোচনার যুগ তখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। কিন্তু তাঁর ক্লাসে ঔপনিবেশিকতার নিষ্ঠুর চেহারা পরিস্ফুট হয়ে উঠত শিক্ষার্থীদের কাছে।

কৈশোরে তাঁর লেখায় যে নির্মোহ বিচার-পদ্ধতি লক্ষ করেছিলাম, সেই একই ধরনের তীক্ষ্ণ ও নিরাবেগ বিশ্লেষণ পেতাম ক্লাসে। ডিকেন্সের উপন্যাসে অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি ভাবালুতার বিস্তার তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। এক মিনিট দেরি করতেন না ক্লাসে ঢুকতে। একটিও বাড়তি কথা বলতেন না। এবং যথাসময়ে শেষ হয়ে যেত প্রতিটি কোর্স। সবাই জানেন, তিনি খুব মিতবাক ও সংযমী, তবু দেখতাম উপন্যাসে শিল্পিত কোনো মুহূর্ত এলে — বিশেষ করে জেন অস্টেনের উপন্যাসে — তাঁর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত আর মুগ্ধ বিস্ময়ে বারবার বলতেন: ‘Notice, notice how she does it!’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম উনিশ শ ছত্রিশ সালে, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগরে। শিক্ষালাভ করেছেন রাজশাহী, কলকাতা ও ঢাকায়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন যুক্তরাজ্যের লীডস ও লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।

দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে শতাধিক বই লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন আরিস্ততল, হেনরিক ইবসেন, এ ই হাউসম্যানের গুরুত্বপূর্ণ বই। সম্পাদনা করেছেন অনেক সাহিত্য ও গবেষণাপত্রিকা। আশি বছর পার হয়ে এসেও নিয়মিত প্রকাশ করে যাচ্ছেন ‘নতুন দিগন্ত’ নামে একটি সারবান সাহিত্যপত্রিকা। ‘দৈনিক সংবাদে’ প্রকাশিত তাঁর কলাম ‘সময় বহিয়া যায়’ যেমন ছিল উপভোগ্য, তেমনি ছিল সমাজ-রাজনীতির সমালোচনায় ক্ষুরধার। পরিবেশ, জাতীয় সম্পদ ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে তিনি সবসময় সক্রিয়।

সাহিত্য ছাড়াও সমাজ-ইতিহাসের বিবিধ প্রসঙ্গ, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদ, ইহলৌকিকতা, সমাজতন্ত্র তাঁর নিরন্তর চর্চার বিষয়। তাঁর চিন্তার বিকাশে তিনটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত প্রথম বই ‘অন্বেষণ’-এ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মূলত উদারনৈতিক। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে প্রকাশিত দ্বিতীয় বই ‘দ্বিতীয় ভুবন’ থেকেই তিনি উদারনৈতিক ভাবধারা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন এবং তাঁর চিন্তা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের দিকে মোড় নেয়। ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন সে সময়ে বামপন্থী সাহিত্যভাবনায় যে উত্তাপের যোগান দিয়েছিল সেটিও হয়ত তাঁকে প্রভাবিত করে। এ পর্যায়ে তিনি উনিশ শতকের নবজাগরণ এবং রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক তীব্র-তীক্ষ্ণ প্রশ্ন তোলেন। তৃতীয় পর্যায়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় এবং বিশ্বায়িত পুঁজির উল্লসিত জয়যাত্রার কালে, পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। পুঁজির শাসনের বর্বরতা ও তার প্রভাবজনিত নানা মতাদর্শিক বিকৃতি সম্পর্কে তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। উত্তরাধুনিকবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ, নয়া-ঐতিহ্যবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন নতুন তত্ত্ব সম্পর্কেও তিনি নির্মোহ ও সন্দিহান। মার্কসবাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতায় তাঁর আস্থা অবিচল। তিনি বিশ্বাস করেন পুঁজির এই নিরঙ্কুশ শাসনের অবসান একদিন হবেই। মানুষের মধ্যে এই চেতনার নতুন জাগরণ ঘটানোর লক্ষ্যে তাঁর সব প্রয়াস নিবেদিত। চিন্তার এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কেও তিনি নতুন উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছেন। ‘রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরী’ (২০১৬) এই নামে গোটা একটি বই-ই তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশ্বাসের সঙ্গে অনেকের ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু সে বিশ্বাসের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। চারদিকে যখন লোভের লকলকে জিহবা আরো উদগ্র হয়ে উঠতে চাইছে, বিচ্যুতি ও রংবদলের মহড়া লজ্জার সব আবরণ খসিয়ে দিতে চাইছে, তখন তাঁর মতো প্রাজ্ঞ, নির্লোভ, বিবেকবান ও একাগ্রচিত্ত মানুষ আজ আর কজন আছেন আমাদের সমাজে? বন্ধুরা একে একে চলে যাচ্ছেন। আলো নিভে যাচ্ছে দ্রুত, ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাদের দাঁড়াবার জায়গা। এক বিশাল প্রজন্ম-ব্যবধান শূন্যতার সীমা বাড়িয়ে চলেছে ক্রমাগত। তাই আজ অন্তরের সব আকুতি দিয়ে বলি, স্যার, আপনি ভালো থাকুন, আরো অনেক বছর আমাদের সঙ্গে থাকুন। আর আলো জ্বালাবার কাজ করে যান নিজের মতো।

 

সূত্র : বিডিনিউজ

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে