আহসান মঞ্জিল ঐতিহাসিক নবাবী আমলের অনন্য স্থাপত্যশৈলী
আদিবা বাসারাত তিমা: যান্ত্রিকতার এই শহরে নিজেকে মানুষ এতটাই ব্যস্ত করে তুলছে যার প্রভাব মানুষিক স্বাস্থ্যে লক্ষণীয়। তবে ব্যস্ততার মাঝে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে বেড়াতে পারলে মন ভালো হয়ে ওঠে। হাওয়াবদল মনে আনে ফুর্তি, বাড়িয়ে দেয় প্রাণশক্তি। হুটহাট ঘুরতে যাওয়ার সময় কোথায় পাই? তাছাড়া রাজধানীর যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসা, ঘুরে বেড়ানো বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই কম সময়ে ঢাকার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করি। এবারের গন্তব্য আহসান মঞ্জিল।
সকালে রওনা দিয়ে ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসা সম্ভব। জায়গাটা অনেক সুন্দর। প্রায় সবসময় দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায় সেখানে। আমরা যথাসময়ে বাসা থেকে রওনা করি আহসান মঞ্জিলের উদ্দেশে। বাসা থেকে আহসান মঞ্জিলে যেতে সরাসরি কোনো বাস নেই। তাই প্রথমে বাসে করে গুলিস্তান, সেখান থেকে রিকশায় চড়ে চলে আসি আহসান মঞ্জিলে।
অনবদ্য অলংকরণসমৃদ্ধ সুরম্য ভবনটি ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন। নবাব পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত প্রাসাদটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ইসলামপুরে অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রও বটে।
আহসান মঞ্জিলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় কেন্দ্র হচ্ছে নবাব পরিবারের বাসভবন। মূল প্রাসাদটি গ্যালারি আকারে রূপান্তর করা হয়েছে। ১৯০৪ সালে তোলা ফ্রিৎজকাপের আলোকচিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন কক্ষ ও গ্যালারি সাজানো হয়েছে।
গ্যালারি ১-এ রয়েছে উনিশ শতকের সৈনিকের বর্ম, ভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সংস্কারপূর্ব ও পরবর্তী আলোকচিত্র, পেইন্টিং এবং নতুন ভবন তৈরির নির্দেশনামা।
গ্যালারি ২-এ দেখা যায় নবাবদের ব্যবহৃত আলমারি, তৈজসপত্র, ফানুস ও ঝাড়বাতি। পরের গ্যালারিতে রয়েছে প্রাসাদ ডাইনিং রুম, নবাবদের আনুষ্ঠানিক ভোজনকক্ষ।
গ্যালারি ৪-এ রয়েছে বক্ষস্ত্রাণ ও শিরস্ত্রাণ, হাতির মাথার কংকাল, অলংকৃত দরমা বেড়া/কাঠছিদ্র অলংকরণ। প্রধান সিঁড়িঘর, দরজার অলংকৃত পাল্লা, ঢাল-তরবারি, বর্শাফলক ইত্যাদি।
গ্যালারি ৫ ও ৬-এ রয়েছে স্যার আহসানউল্লাহ জুবিলি মেমোরিয়াল হাসপাতালে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক কিছু সরঞ্জামাদি।
গ্যালারি ৭-এ রয়েছে মুসলিম লীগ কক্ষ। এ কক্ষ নবাবদের দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালে শাহবাগে সম্মেলনে আগত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ নেতাদের একটি বড় তৈলচিত্র এ গ্যালারিতে আছে। একটি বিলিয়ার্ড কক্ষ রয়েছে গ্যালারি ৮-এ। সে গ্যালারিতে ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্র অনুযায়ী বিলিয়ার্ড টেবিল, লাইটিং ফিটিংস, সোফা প্রভৃতি তৈরি করে সাজানো হয়েছে।
সিন্দুককক্ষ বা ঢাকার নবাবদের কোষাগার হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষ রয়েছে গ্যালারি ৯-এ। এখানে আছে ৯৪ লকারবিশিষ্ট বৃহদায়কার লোহার সিন্দুক। বড় কাঠের আলমারি এবং মাঝারি ও ছোট কয়েকটি সিন্দুক, লোহার গ্রিল, দরজার পাল্লা প্রভৃতি।
গ্যালারি ১০-এ রয়েছে নবাব পরিবারের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পরিচিতি ও বংশতালিকা এবং নবাবদের কাশ্মীরবাসী আদিপুরুষ থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বংশতালিকা ও ইংরেজিতে লেখা আহসানউল্লাহর ডায়রি এবং উর্দুতে জমিপত্তন দেওয়ার দলিল। ১০টি গ্যালারি যেন অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো।
পরের আটটি গ্যালারিতে রয়েছে দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, বুদ্ধিজীবী, সমাজসংস্কারক, কবি-সাহিত্যিক ও অন্যান্য ব্যক্তির তৈলচিত্র ছবি। নবাব সলিমুল্লাহ স্মরণে ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র, নবাবের ব্যবহার্য ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল জিনিস রাখা আছে। নবাব পরিবারের সদস্যরা অন্দরমহলে প্রবেশের জন্য রঙমহল থেকে পশ্চিমাংশের একটি গ্যাংওয়ের মাধ্যমে যাতায়াত করতেন। বর্তমানে তা নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বন্ধ। প্রধান সিঁড়িঘর দোতলায় সাদা সিমেন্টের ভাস্কর্য, আলোকচিত্র ও খোদাই করা কাঠের সিঁড়ি, লাল গালিচা ও ছাদে কাঠের অলংকৃত সিলিং। রয়েছে নবাবদের তাস খেলার কক্ষ। এছাড়াও রয়েছে রাজকীয় অতিথিদের থাকা ও বিশ্রামের জন্য শয়নকক্ষ।
পুরান ঢাকা ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে আহসান মঞ্জিলের ভূমিকা অতুলনীয়। নতুন প্রজন্মের জন্য আহসান মঞ্জিল হতে পারে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো দর্শনার্থী আসে আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন করতে।