হাদিসে ভালো মৃত্যুর আলামত নিয়ে যা বলা হয়েছে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২৪; সময়: ২:৪৩ অপরাহ্ণ |
খবর > ধর্ম
হাদিসে ভালো মৃত্যুর আলামত নিয়ে যা বলা হয়েছে

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : প্রত্যেক জীবের মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুর মুহুর্তটি একজন মানুষের জন্য স্পর্শকাতর। এ সময় মানুষের ঈমান ও বিশ্বাসের ওপর নির্ধারিত হবে তার চিরস্থায়ী ও পরকালের জীবন। এই মুহুর্তটিতে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করে যেতে পারে একজন মুমিনের জন্য সৌভাগ্যের।

মৃত্যুর সময় যিনি আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ উদ্রেককারী গুনাহ হতে বিরত থাকতে পারবেন এবং পাপ থেকে তওবা করতে পারবেন, নেকীর কাজ ও ভাল কাজ বেশি বেশি করার তাওফিক পাবেন। তিনি সন্তোষজনক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলে ধরা হবে। এবং এই অবস্থায় মারা গেলে তা ভালো মৃত্যুর আলামত বলে বিবেচিত।

এ বিষয়ে এক হাদিসে হজরত আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, `আল্লাহ যদি কোনো বান্দার কল্যাণ চান তখন তাকে (ভাল) কাজে লাগান।

সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কীভাবে আল্লাহ বান্দাকে (ভাল) কাজে লাগান? তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর আগে তাকে ভাল কাজ করার তাওফিক দেন।’ (মুসনাদে আহমাদ. হাদিস, ১১৬২৫, তিরমিজি, হাদিস, ২১৪২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যদি কোনো বান্দার কল্যাণ চান তখন সে বান্দাকে ‘আসাল’ করেন। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আসাল কি?

তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে বিশেষ একটি ভাল কাজ করার তাওফিক দেন এবং এই আমলের উপর তার মৃত্যু ঘটান। (সহিহ আহমাদ, হাদিস, ১৭৩৩০)

ভাল মৃত্যুর বেশ কিছু আলামত আছে। এর মধ্যে কোনো কোনো আলামত শুধু মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারে এবং কিছু আলামত অন্যান্য মানুষও জানতে পারে। এখানে এমন কিছু আলামত তুলে ধরা হলো-

আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ-

মৃত্যুকালে বান্দার নিকট তার ভাল মৃত্যুর যে আলামত প্রকাশ পায় সেটা হচ্ছে- বান্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ দেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় পেও না, চিন্তিত হইও না এবং তোমরা প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর।’ (সূরা ফুসসিলত, আয়াত, ৩০)

এ বিষয়ে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাতকে ভালবাসে আল্লাহও তার সাক্ষাতকে ভালবাসেন। যে ব্যক্তির কাছে আল্লাহর সাক্ষাত প্রিয়, আল্লাহর নিকটও তার সাক্ষাত প্রিয়। আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী!

আপনি কি মৃত্যুর কথা বুঝাতে চাচ্ছেন? আমরা তো সবাই মৃত্যুকে অপছন্দ করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, সেটা না। মুমিন বান্দাকে যখন আল্লাহর রহমত, তার সন্তুষ্টি, তার জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করাকে ভালবাসেন।

আর কাফের বান্দাকে যখন আল্লাহর শাস্তি, তার অসন্তুষ্টির সংবাদ দেয়া হয় তখন সে আল্লাহর সাক্ষাতকে অপছন্দ করে এবং আল্লাহও তার সাক্ষাতকে অপছন্দ করেন। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)

ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদিসের অর্থ হচ্ছে- যখন মানুষের মৃত্যুর গড়গড়া শুরু হয়ে যায়, যে অবস্থায় আর তওবা কবুল হয় না, সে অবস্থার পছন্দ-অপছন্দকে এখানে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে পড়ে, তার পরিণতি কী হতে যাচ্ছে সেটা তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।

ভাল মৃত্যুর অনেক আলামত রয়েছে। আলেমগণ কোরআন-হাদিসের আলোকে এই আলামতগুলো বের করার চেষ্টা করেছেন। এই আলামতগুলোর মধ্যে রয়েছে-

মৃত্যুর সময় ‘কালেমা’ পাঠ করা-

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির সর্বশেষ কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস, ৩১১৬)

মৃত্যুর সময় কপাল থেকে ঘাম বের হওয়া-

বুরাইদা বিন হাছিব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, ‘মুমিন কপালের ঘাম নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস, ২২৫১৩), জামে তিরমিজি, হাদিস, ৯৮০, সুনানে নাসায়ি, হাদিস, ১৮২৮)

জুমার রাতে বা দিনে মৃত্যুবরণ করা।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে বা রাতে মৃত্যুবরণ করেন আল্লাহ তাকে কবরের আজাব থেকে নাজাত দেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস, ৬৫৪৬, জামে তিরমিজি, হাদিস, ১০৭৪)

আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা-

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়,তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদযাপন করছে।

আর যারা এখনও তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তাদের পেছনে তাদের জন্যে আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয় ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা ভাবনাও নেই। আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্যে তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ, ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত, ১৬৯-১৭১)

এক হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে নিহত হয় সে শহিদ এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে মারা যায় সেও শহিদ ‘ (সহিহ মুসলিম, হাদিস, ১৯১৫)

প্লেগ রোগে মারা যাওয়া।

এ বিষয়ে এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্লেগ রোগে মৃত্যু প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য শাহাদাত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস, ২৮৩০, সহিহ মুসলিম, হাদিস, ১৯১৬)

আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি তখন তিনি আমাকে জানান যে, ‘এটি হচ্ছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব। আল্লাহ যাদেরকে শাস্তি দিতে চান তাদের উপর এই রোগ নাজিল করেন।

আর আল্লাহ এই রোগ মুমিনদের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। যে মুমিন প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ এলাকাতে অবস্থান করবে, ধৈর্যধারণ করবে, সওয়াবের প্রত্যাশা করবে এবং এই একীন রাখবে যে, আল্লাহ তার জন্য যা লিখে রেখেছেন সেটাই ঘটবে সে ব্যক্তি শহিদের সমান সওয়াব পাবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস, ৩৪৭৪)

যে কোন পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করা।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করবে সে শহিদ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস, ১৯১৫)

কোন কিছু ধ্বসে পড়ে অথবা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করা।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচ ধরনের মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে গণ্য। প্লেগ রোগে মৃত্যু, পেটের পীড়ায় মৃত্যু, পানি ডুবে মৃত্যু, কোন কিছু ধ্বসে পড়ে মৃত্যু এবং আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়া ‘ (সহিহ বুখারি, ২৮২৯, সহিহ মুসলিম, ১৯১৫)

প্রসবের সময় প্রসূতির মৃত্যু অথবা গর্ভবতী অবস্থায় নারীর মৃত্যু।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে নারী জুমা (বাচ্চা) নিয়ে মারা যায় তিনি শহিদ।’ (আবু দাউদ, হাদিস, ৩১১১)

ইমাম খাত্তাবি বলেন, এ হাদিসের অর্থ হচ্ছে- যে নারী পেটে বাচ্চা নিয়ে মারা যায়। ইমাম আহমাদ উবাদা বিন সামেত রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শহিদের শ্রেণীগুলো উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে নারী তার গর্ভস্থিত সন্তানের কারণে মারা যায় তিনি শহিদ। সে নারীকে তার সন্তান সুরার (নাভিরজ্জু) ধরে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে।’

নিজের ধর্ম, সম্পদ ও জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা গিয়ে মারা যায় সে শহিদ। যে ব্যক্তি তার ধর্ম (ইসলাম) রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহিদ। যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহিদ। (জামে তিরমিজি, ১৪২১, সহিহ বুখারি, হাদিস, ২৪৮০, সহিহ মুসলিম, হাদিস, ১৪১)

আল্লাহর রাস্তায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু

আল্লাহর রাস্তায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে ব্যক্তি মারা যায় সেও শহিদ।

হজরত সালমান আল ফারেসি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একদিন, একরাত পাহারা দেয়া একমাস দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম।

আর যদি পাহারারত অবস্থায় সে ব্যক্তি মারা যায় তাহলে তার জীবদ্দশায় সে যে আমলগুলো করত সেগুলোর সওয়াব তার জন্য চলমান থাকবে, তার রিজিকও চলমান থাকবে এবং কবরের ফিতনা থেকে সে মুক্ত থাকবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস, ১৯১৩)

নেক আমলরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি কোন একটি সদকা করল এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস, ২২৮১৩)

এই আলামতগুলো ব্যক্তির ভাল মৃত্যুর সুসংবাদ দেয়। কিন্তু এরপরেও নির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তির ব্যাপারে এ নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না যে, তিনি জান্নাতি। শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদের ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন তারা ছাড়া। যেমন চার খলিফার ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে